জন্ম ও পরিচয়
ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ মনসুর আলী, সিরাজগঞ্জ জেলার রতনকান্দি ইউনিয়নের ‘কুড়িপাড়া’ গ্রামে ১৯১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি জন্মগ্রহন করেন। তার বাবার নাম ছিল হরফ আলী সরকার।
মনসুর আলীর শিক্ষা জীবন সাফল্যমণ্ডিত।তিনি সিরাজগঞ্জ বি.এল. হাইস্কুলে পড়াশুনা করেছেন৷ পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ১৯৪১ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি বি.এ পাস করে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নাম করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন৷১৯৪৫ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে এম.এ এবং ‘ল’ পাস করেন৷ তিনি প্রথম শ্রেণী লাভ করেন এল.এল.বি তে ।১৯৫১ সালে পাবনা জেলা আদালতে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তিনি পাবনা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন।
আলীগড় থেকে দেশে ফেরার পর মনসুর আলী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন৷ ১৯৪৮ সালে তিনি যশোর ক্যান্টনমেন্টে প্রশিক্ষণ নেন এবং পিএলজি এর ক্যাপ্টেন পদে নিযুক্ত হন৷ এ সময় থেকেই তিনি ক্যাপ্টেন মনসুর নামে পরিচিতি লাভ করেন ৷ ইসলামিয়া কলেজে অধ্যায়নরত অবস্থায় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পরিচিত হন৷ ১৯৫১ সালে তিনি আওয়ামী-মুসলিম লীগে যোগদান করেন৷ জড়িয়ে পড়েন সক্রিয় রাজনীতিতে৷ দলের পাবনা জেলা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি৷
রাজনৈতিক জীবন
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন৷ এ নির্বাচনে পাবনা-১ আসনের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আব্দুল্লাহ্ আল মাহমুদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন তিনি৷ এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন মনসুর আলী ৷ আব্দুল্লাহ্ আল মাহমুদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়৷ এরপর যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে যায়৷ ১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে বিভিন্ন সময় পূর্ববঙ্গ কোয়ালিশন সরকারের আইন ও সংসদ বিষয়ক, খাদ্য ও কৃষি এবং শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ৷
১৯৫৮ সালে দেশে জারি হয় সামরিক শাসন৷ তিনি গ্রেফতার হন নিরাপত্তা আইনে৷ মুক্ত হন, ১৯৫৯ সালের শেষের দিকে কারা নির্যাতন ভোগের পর৷ বাঙালির মুক্তির সনদ ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন৷ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচন করেন এবং পাবনা-১ আসন থেকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
স্বাধীনতা ও মনসুর আলী
শহীদ এম মনসুনর আলী সেনাবাহিনীর কোনো ক্যাপ্টেন ছিলেন না। তিনি ছিলেন পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ডের ক্যাপ্টেন। এ বিষয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন।
২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলে মনসুর আলী গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে যান সোবহানবাগ কালোনীতে। এখান থেকে তিনি কেরানীগঞ্জ হয়ে কুড়িপাড়া যান তার পরিবারের সাথে দেখা করতে৷ এরপর চলে যান ভারতে৷ আসামের মাইনকার চর হয়ে তিনি কলকাতা চলে যান৷ ভারতে আশ্রয় নেয়া অন্য নেতাদের সাথে দেখা ও যোগাযোগ হয় তার৷ এরপর দলীয় হাই কমান্ডের অন্য নেতারা মিলে সম্মিলিত সিদ্ধান্তে গঠন করেন মুজিবনগর সরকার৷ নতুন গঠিত সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন মনসুর আলী৷ এবছরের মাঝামাঝি সময়ে তার পরিবারও কলকাতা চলে যায়৷ তিনি সেখানে পরিবারসহ বসবাস করতে থাকেন পার্কসার্কাসের সিআইটি রোড়ের বাড়িতে৷ তার অফিস ছিল ৮নং থিয়েটার রোডে৷
দেশের জন্য জীবন দান
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এম মনসুর আলী ছিলেন তার পাবনার বাড়িটিতে। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাসঘাতকদের হাতে ১৫ আগস্টে পরিবার সহ নিহত হন। ছেলে মোহাম্মদ নাসিমের (বর্তমান স্বাস্থমন্ত্রী) টেলিফোনে এই খবর জানতে পারেন। এরপর মনসুর আলী আবার ঢাকায় আসেন। ‘মীরজাফর’ খন্দকার মোশতাক আহমেদের অবৈধ সরকারের প্রতি আদেশ প্রদর্শন না করায় মনসুর আলীসহ বঙ্গবন্ধুর চার বিশ্বস্ত অনুসারীকে আটক করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হস্তান্তর করা হয়। এরপর ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারে ঘটে যায় পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড। জেলখানার ভেতরে খুন করা হয় নৃশংসভাবে জাতীয় চার নেতা কে এম মনসুর আলী, তাজউদ্দিন আহম্মদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে।
ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর ছেলে মোহাম্মদ নাসিম
‘আমার পিতাকে চিরদিনের জন্য হারানোর আগে মাত্র কয়েক ঘণ্টা তার সঙ্গে আমি ছিলাম। ১৫ আগস্টের সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সে সময় তাকে দেখেছি কী উদ্বেগ ও প্রচণ্ড বেদনা নিয়ে একদিকে বঙ্গবন্ধুকে হারানোর কথা মনে করছেন, অন্যদিকে প্রতিশোধ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রবল ইচ্ছে নিয়ে দলীয় সহকর্মী এবং তখনকার সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। শহীদ এম মনসুর আলী আত্মগোপন অবস্থায়ও চেষ্টা করেছেন নানাভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য। কিন্ত কিছু সহকর্মীর ভীরুতা, আপস এবং জীবন রক্ষার প্রাণান্ত চেষ্টা, অন্যদিকে তখনকার সামরিক-বেসামরিক নেতৃত্বের চরম ব্যর্থতা, চরম কাপুরুষতায় শহীদ এম মনসুর আলী ভীষণভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং হতাশ হয়েছিলেন। কিছু করতে না পারার বেদনা এবং অশ্রুসিক্ত চেহারা আমি দেখেছিলাম। কিন্ত একটা জিনিস ধ্রব তারার মতো সত্য, তিনি জীবন দেবেন। আমার পিতা শহীদ এম মনসুর আলী বিশ্বাসঘাতক মোশতাকের মুখের ওপর বলেছিলেন, ‘তোমার মতো বেঈমানের সাথে আমি হাত মেলাব না। জীবন দেব, প্রধানমন্ত্রী হব না।’ তিনি তাঁর কথা রেখেছেন। শহীদ এম মনসুর আলী আপস করেননি, আত্মসমর্পণ করেননি, জীবনের ভয়ে মাথানত করেননি, ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দি অবস্থায় ঘাতকের হাতে জীবন দিয়েছেন।’
‘চার মৃত্যুঞ্জয়ী নেতার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরদিন। যাঁরা জীবন দিয়েছেন, জাতির জনকের সাথে বেঈমানি করেননি। তাদের ভেতর একজন আমার পিতা শহীদ এম মনসুর আলী। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ ও আমার জীবনের বড় পরিচয়। আমার জীবনে সবচেয়ে বড় গর্ব ও অহংকার হলো আমি খন্দকার মোশতাকের মতো বড় বেঈমানের সন্তান নই। শহীদ এম মনসুর আলীর মতো একজন সাহসী মৃত্যুঞ্জয়ী পিতার সন্তান। নেতা বা নেতার আদর্শের সঙ্গে বেইমানি নয়, বিশ্বাসঘাতকতা নয়, কোনো আপসকামিতা নয়। আমার শহীদ পিতার এই আদর্শ ধরেই আমি কাজ করছি, কাজ করে যাব। ৩ নভেম্বরে শহীদ পিতার প্রতি এটাই আমার প্রত্যয়দীপ্ত শ্রদ্ধা।’ বলছিলেন মোহাম্মদ নাসিম।