ক্ষুদিরাম বসু এর জীবনী

by Zabed Ahmed

ক্ষুদিরাম বসু: এমন রায়ে সারা বাংলা উত্তাল হয়ে উঠল ।

মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিন ঠিক করা হল ১১ অগাস্ট ১৯০৮, সকাল ৬ টায় | ১৫ ফুট উচু ফাঁসির মঞ্চ সাজানো হয়েছে মাত্র ১৮ বছরের এক কিশোরের (ক্ষুদিরাম বসু) জন্য। ভোর ৫টা থেকেই জেল প্রান্তর ও রাস্তার দু’পাশে অজস্র মানুষ এসে ভীড় জমিয়েছেন সেই ১৮ বছরের কিশোরকে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য।

কিন্তু কে ছিলেন এই কিশোর, কেন থাকে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই ঝুলতে হয় ফাঁসির কাষ্ঠে, কেনইবা তার প্রতি অজস্র মানুষের এতো ভালোবাসা।

তাকে নিয়ে মুকুন্দ দাস একটি বিখ্যাত  গানও লিখেছিলেন 

“হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী

একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি”

কবি আল মাহমুদ লিখেছেনঃ-

“চিনতে না কি সোনার ছেলে ক্ষুদিরামকে চিনতে ?

রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে মুক্ত বাতাস কিনতে ?”

জন্ম ও  নামকরণ:

ক্ষুদিরাম বসু

১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর মেদিনীপুর শহরের কাছাকাছি (বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা) কেশপুর থানার অন্তর্গত মৌবনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন  ক্ষুদিরাম বসু | পিতাঃ ত্রৈলোক্যনাথ বসু – পেশায় নারাজোলের তহসিলদার ছিলেন,  মাতাঃ লক্ষীপ্রিয় দেবি।৩বোন ১ভাই-এর মধ্যে ক্ষুদিরাম ছিলেন সবার ছোট।ক্ষুদিরামের জন্মের পূর্বে তার দুই ভাই অকালে মৃত্যু বরন করেন।

দুই পুত্রের অকাল মৃত্যুতে ক্ষুদিরামের মা লক্ষীপ্রিয় দেবী অপর পুত্রের (ক্ষুদিরামের) মৃত্যুর আশংকায় মাত্র ৩-মুঠো  খুদের (চালের খুদ/ খাদ্য শশ্যে) বিনিময়ে তাকে বিক্রি করে দেন। ৩-মুঠো খুদের বিনিময়ে বিক্রি হওয়ায় তার নাম রাখা হয় ক্ষুদিরাম। 

কিন্তু কেউ’কি জানতো অকাল মৃত্যুর ভয়ে ৩-মুঠো খুদের বিনিময়ে বিক্রি করে দেওয়া ক্ষুদিরাম মরে গিয়েও বাঙ্গালীর চেতনায় বেচে রইবে অনন্তকাল।

শৈশব ও শিক্ষাজীবন:

ক্ষুদিরামের বয়স যখন মাত্র ৫,  ঠিক তখনি তার মা মারা যান, এবং এর এক বছর পর পিতা মারা গেলে অনাথ ক্ষুদিরামকে তার বড় বোন অপরুপা দেবি তাকে নিজের বাড়ি দাশপুরে নিয়ে যান। সেখানে ক্ষুদিরামের ভগ্নিপতি (বোনের জামাই) অমৃতলাল রায় তাকে তমলুকের হ্যামিলটন স্কুলে ভর্তি করে দেন।

ক্ষুদিরাম ছোটবেলা থেকেই ছিলেন ভিষণ চঞ্চল ও দুষ্ট স্বভাবের। সারাদিন খেলা-ধুলা ও বন্ধুদের নিয়ে হই হোল্লড় করে বেড়াতেন সারা পাড়া। পড়াশোনায় অমনোযোগী হওয়ায় প্রতিনিয়তই স্যারদের তিরস্কারের শিকার হতেন ক্ষুদিরাম। তাই অষ্টম শ্রেণীতেই পড়ালেখার সমাপ্তি ঘটান ক্ষুদিরাম |

বিপ্লবী ক্ষুদিরাম:

স্কুল জীবন ছাড়লেও স্কুলের অদুরে ভবানী মন্দিরে প্রতিনিয়ত যেতেন ক্ষুদিরাম। আর সেখানেই তার পরিচয় হয় সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে। ১৯০২ সালে রাজনারায়ণ বসুর প্রাভাবে গড়ে উঠা বিপ্লবী গুপ্ত সংগঠনের নেতা হেমচন্দ্র দাস কানুনগো এর সহকারী ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু । ১৯০৩ সালে ভগ্নিপতি অমৃতলাল রায়ের সাথে মেদিনীপুর ভ্রমণ করেন ক্ষুদিরাম। সেখানেই তা বিপ্লবী জীবনের অভিষেক হয়।  মেদিনীপুরে কিশোর ক্ষুদিরাম স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী গোষ্ঠীর সকল সমাবেশ, গোপন বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। দেশভক্ত শ্রী অরবিন্দু ও সমাজ সেবক ভগিনী নিবেদিতার বক্তৃতা শুনে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই প্রকাশ্যে জড়িয়ে পড়েন স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী গোষ্ঠী “অনুশীলন সমিতি” তে। সেসময় ক্ষুদিরামের পরিচয় হয় বারীন্দ্র কুমার ঘোষের সাথে। বারীন্দ্র কুমার ঘোষ ছিলেন শ্রী অরবিন্দুর আপন ছোট ভাই | অনুশীলন সমিতির স্বেচ্ছাসেবী হয়ে ভারতে ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে “সোনার বাংলা” শির্ষক প্রচারপত্র বিলি করার অপরাধে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন ক্ষুদিরাম। কিন্তু বয়স কম হওয়ায় তখন ছাড়া পেয়ে যান তিনি। ছাড়া পেয়ে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম ব্রিটিশ সরকারী আধিকারীদের উপর আক্রমণের লক্ষে পুলিশ স্টেশন সহ চিহ্নিত সরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোতে বোমা মজুত করতে থাকেন। ১৯০৪ সালে ক্ষুদিরাম ভগ্নিপতি অমৃতলাল রায়ের সাথে তমলুক থেকে একেবারে  মেদিনীপুর চলে আসেন ক্ষুদিরাম।

খুব স্বল্প সময়ই ক্ষুদিরাম তার দুঃসাহসি বেপরোয়া কাজের জন্যে সবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেন। মেদিনীপুর ক্ষুদিরাম সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সাহায্যে বিপ্লবী গুষ্টি অনুশীলন সমিতিতে নিজের অবস্থান পরিপক্ব করে নেন। ১৯০৬ সালে কসাই নদীর বন্যায় কবলিতদের মাঝে রণপা’র সাহায্যে ত্রাণও বিতরণ করেন।

বোমা হামলার পরিকল্পনা:

রাজনৈতিক ও সামরিক শিক্ষার উদ্দেশ্য ১৯০৭ সালে বারীন্দ্র ঘোষ ও তার সহযোগী হেমচন্দ্র প্যারিসে অবস্থানকালে “নিকোলাস” সানফ্রান্সিসকো নামক এক রাশিয়ান এর কাছ থেকে  বোমা তৈরীর কৌশল শিখে আসেন।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেই বারীন্দ্র ঘোষ ও হেমচন্দ্র ক্ষুদিরামের সাহায্যে “ডগলাস  কিংসফোর্ড” কে তাদের পরবর্তী হামলার শিকার হিসেবে স্থির করেন। ডগলাস কিংসফোর্ড ছিলেন আলিপুর প্রেসিডেন্সি বিচারালয়ের প্রধান ম্যাজিস্টেট। যার হাতে স্বামী বিবেকানন্দের বড় ভাই বিপ্লবী পত্রিকা “যুগান্তর” এর সম্পাদক ভূপেন্দ্র নাথ দত্ত ও পত্রিকার অন্যান্য সম্পাদকের মামলা চলছিল। কিংসফোর্ড তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় কঠোর সাজা শুনিয়ে ছিলেন। যুগান্তর পত্রিকা মূলত ব্রিটিশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লেখালেখি করতো। তাই এ ব্যাপারে কিংসফোর্ড “যুগান্তর” পত্রিকার আরো ৫জন সম্পাদককে অভিযুক্ত করেন। এতে বিপ্লবী যুগান্তর পত্রিকা অর্থিকভাবে ভিষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুগান্তর’র সম্পাদকদের মামলার বিরুদ্ধে কথা বলায় – সুশীল সেন নামে আরেক বিপ্লবী কিশোরকে চাবুক মারার আদেশ দিয়ে জাতীয়তাবাদীদের কাছে কুখ্যাতি অর্জন করেন কিংসফোর্ড।

কিংসফোর্ড হত্যার চেষ্টা:

কিংসফোর্ডকে হত্যার উদ্দেশ্য  হেমচন্দ্রের তৈরী বই বোমা বাদামী কাগজে মুড়িয়ে পরেশ মল্লিক কে দিয়ে কিংসফোর্ডের বাড়িতে পাঠানো হয়। ব্যাস্ততার কারনে কিংসফোর্ড বইটি খুলো দেখেননি। ১৯০৮ সালে কিংসফোর্ডকে পদোন্নতি করে বিহারের মুজাফফরপুর জেলার বিচারপতি নিয়োগ করা হলে, কিংসফোর্ড মুজাফফরপুরে চলে যান। তাই বই বোমাটি আগের বাসায় রয়ে যায়।

মুজাফফরপুরে কিংসফোর্ড হত্যা চেষ্টা: ১ম পরিকল্পনা ব্যার্থ হলেও অনুশীলন সমিতি – কিংসফোর্ড হত্যার প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। সেই উদ্দেশ্য বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি মুজাফফরপুর চলে আসেন এবং কিংসফোর্ড এর উপর তারা নজরদারি শুরু করেন। ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকি লক্ষ করেন যে, কিংসফোর্ড মুজাফফরপুর ব্রিটিশ ক্লাবের উল্টো দিকে একটি পার্কে ঘনঘন যেতেন। ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি মনস্থির করেন যে ঐ পার্কেই কিংসফোর্ড এর উপর বোমা হামলা করবেন। পরিকল্পনা মতো ২৯ শে এপ্রিল সন্ধ্যায় স্কুল ছাত্রের ভান ধরে তারা দুজন জায়গা মতো উপস্থিত হয়। সেদিন ঐ ক্লাবে কিংসফোর্ডের গাড়ির মতো দেখতে আরেকটা গাড়ি উপস্থিত ছিলো, গাড়িতে ছিলেন প্রিঙ্গেল কেনেডি নামের একজন ব্রিটিশ ব্যারিষ্টারের স্ত্রী ও মেয়ে।কেনেডি পরিবারের ঘাড়িটি যখন প্রদান ফটকে আসে, তৎক্ষনাৎ ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি কিংসফোর্ডের গাড়ি ভেবে ঐ কেনেডি পরিবারের গাড়িতে বোমা হামলা করেন। বোমা হামলায় কেনেডির স্ত্রী ও মেয়ে মারা যায়। 

বোমা হামলার পর ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকি নিজেদের প্রাণ রক্ষার্থে দু’জন দুদিক পালিয়ে যায়। প্রফুল্ল চাকি সমস্তিপুর স্টেশন পৌছালে সেখানে তার দেখা হয় রেলস্টেশন কর্মচারি ত্রিগুণ চরণ এর সাথে। ত্রিগুণ চরণ সব ঘটনা শুনে প্রফুল্ল চাকিকে কলকাতা যাবার ব্যাবস্থা করে দেন। দুর্বাগ্যবশত প্রফুল্ল চাকি ট্রেনের যে বগিতে উঠেন সে বগিতে আগ থেকেই ভ্রমণ করছিলেন ব্রিটিশ পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর নন্দলাল ব্যানার্জি। কথোপকথনের এক পর্যায়ে নন্দলাল বুঝতে পারেন যে, প্রফুল্ল চাকিই কিংসফোর্ডের উপর বোমা হামলাকারীদের মধ্যে একজন। নন্দলাল তাকে আটক করার চেষ্টা করলে প্রফুল্ল চাকি আত্নরক্ষায় ব্যার্থ হওয়ায় নিজের সাথে থাকা রিভলবার দিয়ে নিজের মুখে গুলি করে আত্মহত্যা করেন।

বিপ্লবী ক্ষুদিরামের ধরা পরা:

বোমা হামলার পর ক্ষুদিরাম পালিয়ে প্রায় ২৫ কিলোমিটার হেঠে “ওয়াইনি” নামক স্টেশন  এসে পৌছান। বোমা হামলার ঘটনা সারা শহরে জানাজানি হয়ে গিয়েছিল, তাই সমস্ত স্টেশন গুলোতে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়। ক্ষুদিরাম ওয়াইনি স্টেশনে পৌছালে সেখানে তার মুখামুখি হয় শিউ প্রসাদ ও ফতেহ শিং নামের দুই ব্রিটিশ কনস্টেবল এর সাথে। তারা ক্ষুদিরামের বিধ্বস্ত চেহারা ও ঘামার্থ শরীর দেখে সন্দেহবশবর্তী হয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। কনস্টেবলদের হাত থেকে পালায়ন করতে গিয়ে ক্ষুদিরামের সাথে থাকা ২টি রিভলবারের ১টি মাটিতে পড়ে যায়। এতে ফতেহ সিং ও শিউ প্রসাদ নিশ্চিত হয়ে যান যে ক্ষুদিরাম’ই কিংসফোর্ড এর উপর বোমা হামলা করেন। তারা ক্ষুদিরামকে ধরতে পেছনে দাওয়া করে এবং ধরে ফেলে। তখনকার সেই ওয়াইনি স্টেশন বর্তমানে “ক্ষুদিরাম বোস পুসা” স্টেশন নামে পরিচিত।

মুজাফফরপুর থেকে ১লা মে হাতে হাতকড়ি লাগিয়ে ক্ষুদিরামকে আনা হয়  জেলা শাসক মিস্টার উডম্যানের বাড়িতে। ২মে ইংরেজ দৈনিক পত্রিকা “দ্যা স্টেটসম্যান” ক্ষুদিরামকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তারা লিখেছিলো 

“একটা ছেলেকে দেখার জন্যে রেল স্টেশনে ভিড় জমে যায়। ১৮ অথবা ১৯ বছরের এক কিশোর হলেও তাঁকে রীতিমতো দৃঢ় দেখাচ্ছিল। বাইরে তার জন্যেই রাখা এক চারচাকার খোলা গাড়িতে উঠতে প্রথম শ্রেণীর এক রেল কামরা থেকে বেরিয়ে সে হেঁটে আসছিল, এক উৎফুল্ল কিশোরের মতো, যে কোনো উদ্বেগ জানেনা….গাড়িতে নির্দিষ্ট আসনে বসার সময় ছেলেটা চিৎকার করে বলে উঠল ‘বন্দেমাতরম্’।”

ক্ষুদিরামের ফাসি:

 ক্ষুদিরামকে বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হলো, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে  ক্ষুদিরাম বোমা হামলার দায়বার শিকার করেন, এমনকি তিনি প্রফুল্ল চাকির কথাও চেপে যান। অবশেষে মৃত্যুদন্ডের রায় হয় ক্ষুদিরামের। এমন রায়ে সারা বাংলা উত্তাল হয়ে উঠল। কিন্তু মৃত্যদন্ডের রায় শুনে মুচকি হাসেন ক্ষুদিরাম |

মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিন ঠিক করা হল ১১ অগাস্ট ১৯০৮, সকাল ৬ টায় | ১৫ ফুট উচু ফাঁসির মঞ্চ সাজানো হয়েছে মাত্র ১৮ বছরের বিপ্লবী কিশোর ক্ষুদিরাম জন্য। ভোর ৫টা থেকেই জেল প্রান্তর ও রাস্তার দু’পাশে অজস্র মানুষ এসে ভীড় জমিয়েছেন সেই ১৮ বছরের বিপ্লবী ক্ষুদিরামেরকে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য।

*বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রামে ক্ষুদিরাম বসু ছিলেন প্রথম বাঙালি বিপ্লবী *

তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা ও তার ঐতিহ্য নিয়ে ইতোমধ্যে আলোচনা করেছি। আপনি চাইলে সেটি পড়ে আসতে পারেন।

Related Posts

Leave a Comment