চন্দ্রদ্বীপ হল প্রাচীন বাংলার একটি জনপদ । বর্তমান বরিশাল জেলা চন্দ্রদ্বীপের মূল ভূখণ্ড প্রাণকেন্দ্র। এ প্রাচীন জনপদটি বালেশ্বর ও মেঘনার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ছিল।দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় মুসলিম আদিপত্য বিস্তার কালে তখনকার রাজা দনুজমর্দন ‘চন্দ্রদ্বীপ’ নামের একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত রাজ্যটি চন্দ্রদ্বীপ নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করে। চন্দ্রদ্বীপ নামের আগে এ অঞ্চলটির নাম ছিল ‘বাকলা’। তাই একপর্যায় অঞ্চলটি বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নামে পরিচিতি পায়।
চন্দ্রদ্বীপের নামকরণ
প্রাচীনকালে বৃহত্তর বরিশাল জেলা ‘বাকলা’নামে পরিচিত ছিল । দক্ষিণ ভারতীয় লেখনি ও আইন-ই-আকবরীতে উল্লেখ করা হয় চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চলের অন্য নাম ছিল বঙ্গলাদেশ । কালের বিবর্তনে বঙ্গলা শব্দটি ‘বাকলা’ হিসেবে পরিচিত লাভ করে। চতুর্দশ শতাব্দী প্রথমদিকে দনুজমর্দন দেব বাংলা ‘বাকলা’ অঞ্চলে চন্দ্রদ্বীপ নামে একটি স্বাধীন হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন ।কথিত আছে যে চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী নামে একজন ব্রাহ্মণ এর কৃপায় দনুজমর্দন দেব রাজ্য লাভ করেন এবং উক্ত ব্রাহ্মণের নামে তিনি রাজ্যের নামকরণ করেন চন্দ্রদ্বীপ। এক পর্যায়ে অঞ্চলটি ‘বাকলা’চন্দ্রদ্বীপ নামে পরিচিতি পায় যা 1796 সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। দনুজমর্দন দেব ছিলেন চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তার আসল নাম “রামনাথ দে” দনুজমর্দন তার নামের উপাধি ।
চন্দ্রদ্বীপ জনপদের রাজধানী
চন্দ্রদ্বীপের রাজধানী ছিল কচুয়া, বর্তমানে পটুয়াখালী জেলার বাউফাল উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের কচুয়া নামক স্থানে।১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বারভূঁইয়ার অন্যতম রাজা কন্দপনারায়ণ রাজত্ব গ্রহণ করেন। এই সময় মগ পর্তুগীজ জলদস্যুদের অত্যাচার অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। এজন্য কন্দপনারায়ণ প্রথমে বাখরগঞ্জের বাসুরীকাঠি ও পরে বাবুগঞ্জের ক্ষুদ্রকাঠিতে রাজধানী স্থানান্তর করেন। ১৫৯৮ খ্রিষ্টাব্দে পাঠানদের সাথে একযুদ্ধে তিনি নিহত হলে, তাঁর পুত্র রামচন্দ্র সিংহাসনে বসেন। তিনি প্রথমে ঝালকাঠির হোসেনপুরে ও পরে বাবুগঞ্জের মাধবপাশায় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান বরিশাল শহরের ১১ কি.মি পশ্চিমে দুর্গাসাগরের অদূরে সেসময়ের ভবনাদির ভগ্নাবশেষ এখনো অবশিষ্ট আছে। ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে মুঘলদের হাতে স্বাধীন রাজা রামচন্দ্রের পতন ঘটে। পরবর্তী সময়ে শাহ সুজা, বুজুর্গ উমেদ খান, কীর্তিনারায়ন, উদয় নারায়ন প্রমুখ বাকলার রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদান করেন। শায়েস্তা খানের পুত্র উমেদ খান ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগীজ দস্যুদের কঠোর হস্তে দমন করেন।
আঠার শতকের প্রথমার্ধে বরিশালের ইতিহাসের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব আগা বাকেরের আবির্ভাব ঘটে। তিনি বুজুর্গ উমেদপুর ও সেলিমাবাদ পরগণা করায়ত্ত করে এক বিশাল জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে নবাব আলীওয়ার্দী তাঁকে চন্দ্রদ্বীপ পরাগণার প্রশাসক নিযুক্ত করেন। বুজুর্গ উমেদপুরে তিনি একটি ব্যবসাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে যার নাম হয় বাখরগঞ্জ।
বরিশালের নামকরণ
বরিশালের নামকরণ সম্পর্কে অনেক মতভেদ আছে। বড় বড় শালগাছের কারণে (বড়+শাল)= বরিশাল; পর্তুগীজ বেরী ও শেলীর প্রেম কাহিনীর জন্য বরিশাল; বড় বড় লবণের গোলার জন্য বরিশাল ইত্যাদি। এ জেলার লবণের বড় বড় চৌকি ও লবণের বড় বড় দানার জন্য ইংরেজ ও পর্তুগীজ বণিকরা এ অঞ্চলকে ‘বরিসল্ট’ বলত। এ বরিসল্ট পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল হয়েছে বলে অনেকের ধারণা।
বরিশাল দক্ষিণ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা এবং বরিশাল বিভাগের সদর দপ্তর। সংক্ষেপে এর সীমারেখা হচ্ছে উত্তরে শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ, পশ্চিমে গোপালগঞ্জ, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি, দক্ষিণে বরগুনা ও পটুয়াখালী এবং পূর্বে ভোলা ও লক্ষ্মীপুর। কীর্তনখোলা নদীর তীরে অবস্থিত এ শহরের পুরাতন নাম চন্দ্রদ্বীপ। দেশের খাদ্যশস্য ও মৎস্য উৎপাদনের অন্যতম মূল উৎস বরিশাল। একে বাংলার ভেনিস বলা হয়। বরিশাল দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর।
চন্দ্রদ্বীপের রাজাগণ
- রাজা রামনাথ দনুজমর্দন দেব,
- তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা রমাবল্লভ,
- তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা কৃষ্ণ বল্লভ,
- তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা হরিবল্লভ,
- তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা জয়দেব,
- তদীয় উত্তরাধিকারী রাণী কমলা-স্বামী বলভদ্র বসু,
- তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা পরমানন্দ বসু,
- তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা জগদানন্দ বসু (মৃত্যু ১৫৮৪ খ্রি.),
- তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা কন্দর্প নারায়ণ বসু (১৫৮৪ – ১৫৯৮খ্রি.),
- তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা রামচন্দ্র বসু (১৫৯৮ খৃ:-১৬৬৮ খ্রি.),
- তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা কীর্তি নারায়ণ বসু- রাজা বাসুদেব নারায়ণ বসু (১৬৬৮-১৬৬৮ খ্রি.),
- তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা প্রতাপ নারায়ণ বসু (১৬৮৮-১৭২৩ খ্রি.),
- তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা প্রেমনারায়ণ, বিমলা, স্বামী গৌরীচরণ মিত্র,
- তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা উদয়নারায়ণ মিত্র (১৭২৩-১৭৬৮ খ্রি.),
- তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা শিবনারায়ণ মিত্র, স্ত্রী রাণী দুর্গাবতী (১৭৬৯ – ১৭৭৭খ্রি.),
- তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা লক্ষ্মনারায়ণ, রাজা জযনারায়ণ- (১৭৭৮-১৮১৩খ্রি.),
- তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা নৃসিংহ নারায়ণ,
- তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা দেবেন্দ্র নারায়ণ (দত্তক), রাজা নরেন্দ্র নারায়ণ (দত্তক), রাজা বীরসিংহ নারায়ণ (দত্তক),
- তদীয় উত্তরাধিকারী উপেন্দ্র নারায়ণ, ভুপাল নারায়ণ (গোপাল রাজা),
- তদীয় উত্তরাধিকারী সতীন্দ্র নারায়ণ (মাখন রাজা)।
চন্দ্রদ্বীপের শেষ অধ্যায়
মুগল-পূর্ব যুগের ক্ষুদ্র রাজ্য চন্দ্রদ্বীপ মুগল যুগের শেষ দিকে সুবে বাংলার একটি বড় জমিদারিতে রূপান্তরিত হয়। মধ্যযুগের শেষ দিকে বাখরগঞ্জ জেলার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ব্যাপী চন্দ্রদ্বীপ জমিদারি বিস্তৃত ছিল। পূর্ব বাংলার যে সকল জমিদার কিছু কালের জন্য মুগল প্রভুত্ব স্থাপনে প্রতিরোধ রচনা করেন, সে বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে পরমানন্দের পৌত্র কন্দর্পনারায়ণ রায় সবিশেষ প্রসিদ্ধ। কন্দর্পনারায়ণ চন্দ্রদ্বীপের সীমানা সম্ভবত পশ্চিমে যশোহর এবং উত্তরে ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। বহিরাক্রমণ থেকে দেশ রক্ষার জন্য তিনি রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্তে সমুদ্রোপকূলে এক সুদৃঢ় দুর্গ নির্মাণ করেন। কন্দর্পনারায়ণ রায় বরিশালের পশ্চিম-উত্তর কোণে ক্ষুদ্রকাঠিতে একটি দিঘি খনন করেন।কন্দর্পনারায়ণের পুত্র রামচন্দ্র যশোহরের প্রতাপাদিত্যের কন্যা বিন্দুমতীকে বিবাহ করেন। অবশ্য এ ঘটনার মাধ্যমে যশোহর ও চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের মধ্যে প্রীতির সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল বলে মনে হয়। রামচন্দ্র ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে হোসেনপুরে তাঁর রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেন। ভুলুয়ার রাজা লক্ষ্মণমাণিক্যকে তিনি যুদ্ধে পরাজিত করেন।রামচন্দ্র রায়ের পুত্র ও উত্তরাধিকারী কীর্তিনারায়ণ রায়ও পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন এবং সাফল্য লাভ করেন। তাঁর সৎ ভাই প্রতাপনারায়ণ রায় চন্দ্রদ্বীপের পরবর্তী শাসক হন। প্রতাপনারায়ণ রায়ের সময় বা তার স্বল্প পরে মুসলমানগণ বাকলা চন্দ্রদ্বীপ দখল করেন এবং চন্দদ্বীপ তখন সুবে বাংলার একটি জমিদারিতে পণত হয়।
কালক্রমে চন্দ্রদ্বীপের বসু বংশের বিলোপ ঘটলে ঢাকার নিকটবর্তী উলাইলের মিত্র মজুমদার বংশ চন্দ্রদ্বীপের জমিদারি লাভ করেন। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পরপরই চন্দ্রদ্বীপ জমিদারির অধিকাংশ ক্রমে নিলামে বিক্রি হয়।
বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু এর জীবনী এবং উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিয়ে ইতোমধ্যে আলোচনা করেছি। আপনি চাইলে সেটি পড়ে আসতে পারেন।