প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা এর ইতিহাস

by Sarwar Husain

বিদ্যমান মানব সভ্যতা কোন স্তরে আছে তা আমাদের জানা আছে। যা তেমন টি জানা নাই হচ্ছে মিশরীয় সভ্যতা এর রুপ। তাই প্রশ্নের ‍উওর দেওয়ার আগে মিশরীয় সভ্যতা ক্রমবিকাশ এবং খুটিনাটি সর্ম্পকে কিছু ধারণা দেয়া যেতে পারে। এটা শুধু প্রেশ্নের উত্তরের জন্যই নয় সবার জ্ঞান ভান্ডার কিছুটা হলেও সমৃদ্ধ করার,বিশেষ করে তরুণ পাঠকদের জন্য,মিশরের সভ্যতার পুনো ইতিহাসের একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো ।

আফ্রিকা মহাদেশের উওর-পূর্ব অংশে বর্তমানে যে দেশটির নাম ইজিপ্ট,সেই দেশের প্রাচীন নাম মিশর। খ্রিষ্ট পূর্ব ৫০০০ থেকে ৩২০০ অব্দ পর্যন্ত নীল নদের অববাহিকায় একটি সমৃদ্ধ জনপদে উদ্ভব হন।এ সময় থেকে মিশর প্রাচীন সভ্যতায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে শুরু করে। এরপর ৩২০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ থেকে প্রথম রাজ বংশের শাসন আমল শুরু ঐ সময় থেকে মিশরকে একত্রিত করে ‘নারমার’ বা ‘মেনেস’ একাধারে মিশরের প্রথম নরপতি এবং পুরোহিত হন। তিনি প্রথম ফারাও এর মর্যাদা ও লাভ করেন।এর পর ফারাওদের অধীনে মিশন প্রাচীন বিশ্ব সভ্যতার অগ্রগতিতে একের পর এক উল্লেখ যোগ্য অবদান রাখতে শুরু করে।

নীল নদ

নীল নদ শব্দটি আরবি আন্নিল হতে এসেছে। নীল নদ আফ্রিকা মহাদেশের একটি নদী পানি প্রবাহের দিক থেকে এটি দ্বিতীয়। নীল নদ উগান্ডার জেঙ্গা শহর থেকে উৎপত্তি হয়ে ৬৬৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে ভূমধ্যসাগরে মিলিত হয়। ইতিহাসের জনক ‘হেরোডোটাস’ যথার্থই বলেছেন-মিশর নীল নদের দান। নীল নদ না থাকলে মিশর মরুভূমিতে পরিণত হতো। প্রাচীনকালে মিশরে প্রতি বছর নীল নদে বন্যা হতো। বন্যায় প্রচুর পরিমান পলি  আসতো। বন্যার পানি সরে গেলে দুই তীরে পলিমাটি পড়ে জমি উর্বর হয়ে যেতো।জমে থাকা পলিমাটিতে জন্মাতো নানা ধরনের ফসল।

ভৌগোলিক অবস্থান

মিশরের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মহাদেশ দ্বারা ঘিরে আছে। মিশর দেশটি ভূমধ্যসাগরের উপকূলে অবস্থিত এশিয়া,আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত। মিশরের উত্তরে ভূমধ্যসাগর,পূর্বে লোহিত সাগর, পশ্চিমে মরুভূমি, দক্ষিণে সুদান ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশ। মিশরের মোট আয়তন প্রায় চার লক্ষ বর্গমাইল।

মিশরীয় রাষ্ট্র ও সমাজ

প্রাক রাজ বংশীয় যুগে মিশর কতক গুলো ছোট ছোট নগর রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিলে। এগুলো কে ‘লোম’ বলা হয়। মিশরের প্রথম রাজা বা ফারাও এর (মেনেস বা নারমার) অধীনে ঐক্যবদ্ধ মিশরের রাজধানী ছিল দক্ষিণ মেম্ফিস। তখন থেকে মিশরে ঐক্যবদ্ধ রাজ্য ও রাজবংশের উদ্ভব। মিশরীয় ‘পের-ও’ শব্দ থেকে ফারাও শব্দের জন্ম।  তারা ছিল অত্যন্ত ক্ষমাশীল।

মিশরীয়দের পেশার ওপর ভিত্তি করে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যেমন -রাজপরিবার ,পুরোহিত, অভিজাত,লিপিকার, ব্যবসায়ী, শিল্পী এবং কৃষক ও ভূমিদাস শ্রেণী। ফারাও রা নিজেদের সূর্য দেবতার বংশধর মনে করত । ফারাও পদটি ছিল বংশানুক্রমিক।অর্থাৎ ফারাওয়ের ছেলে হতো উত্তরাধিকার সূত্রে ফারাও।

মিশরের অর্থনীতি মূলত ছিল কৃষিনির্ভর। উৎপাদিত ফসলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গম ,যব, তুলা, পেঁয়াজ, পিচফল ইত্যাদি। ব্যবসা-বাণিজ্য মিশর ছিল অগ্রগামী। মিশরে উৎপাদিত গম, লিনেন কাপড় ও মাটির পাত্র ক্রিট দ্বীপ, ফিনিশিয়া, ফিলিস্তিন ও সিরিয়ায় রপ্তানি হতো। মিশরীয়রা বিভিন্ন দেশ থেকে স্বর্ণ, রৌপ্য, হাতির দাঁত, কাঠ ইত্যাদি আমদানি করত।

মিশরীয়দের ধর্ম বিশ্বাস

প্রাচীন কালে ধর্ম ছিল মিশরীয়দের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তারা বিশাল আকারের পিরামিড বানিয়েছে , মমি বানিয়েছে। এ সব কিছু করেছে ধর্মের অনুপেরুণায়। সম্ভবত প্রাচীন মিশরীয়দের মতো অন্য কোনো জাতি জীবনের সকল ক্ষেত্রে এতটা ধর্মীয় নিয়ম-কানুন অনুশাসন দ্বারা প্রভাবিত ছিল না। সে কারণে মানব সভ্যতার অনেক ধ্যানধারণা, রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠানের জন্ম প্রাচীন মিশরে। তারা জড়বস্তুর পূজা করত আবার তারা জড়বস্তর পূজা করত। বিভিন্ন সময় তাদের ধর্মবিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটেছে। মিশরীয়দের ধারণা ছিল -সূর্যদেবতা ‘রে’ বা ‘আমন রে’ এবং প্র্রাকৃতিক শক্তি, শস্য ও নীল নদের দেবতা ‘ওসিরিস’ মিলিতভাবে সমগ্র পৃথিবী পরিচালিত করেন। তবে তাদের জীবনে সূর্যদেবতা‘রে’-গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি ।

মিশরীয়রা মনে করত মৃত ব্যক্তি আবার একদিন বেচেঁ উঠবে সে কারণে দেহকে তাজা রাখার জন্য তারা মমি করে রাখত। এই চিন্তা থেকে মমিকে রক্ষার জন্য তারা পিরামিড তৈরি করেছে। ফারাওরা স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে দেশ শাসন করত। তারা ছিল প্রধান পুরোহিত এবং অন্যান্য পুরোহিতকে তারা নিয়োগ করত।

শিল্প

মিশরের চিত্রশিল্প গড়ে উঠেছিল ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে। মিশরীয়দের  চিত্রকলা বৈচিত্রপূর্ণ ও ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। তারা সমাধি আর মন্দিরের সাজাতে গিয়ে চিত্র শিল্প সূচনা করে। তাদের প্রিয় রং ছিল সাদা-কালো। সমাধি, পিরামিড, মন্দির, প্রাসাদ, প্রমোদ কানন, সাধারণ ঘর বাড়ির দেয়ালে মিশরীয় চিত্রশিল্পরা অসাধারণ ছবি একেছেন । 

কারু শিল্পে ও প্রাচীন মিশরীয় শিল্পীরা অসাধারন দক্ষতা অর্জন করেছেন। আসবাবপত্র, মৃৎপাত্র, সোনা রুপা, মূল্যবান পাথরের খচিত তৈজসপত্র , অলঙ্কার, মমির মুখোশ, দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র, হাতির দাঁত ,ও ধাতুর দ্রবাদি মিশরীয় কারুশিল্পের অসাধারণ দক্ষতা প্রমান করে ।

ভাস্কর্য

ভাস্কর্য শিল্পে মিশরীয়দের মতো প্রতিভার ছাপ আর কেউ রাখতে সক্ষম হয় নি। তাদের তৈরি ভাস্কর্য গুলোর মধ্যে হলো ধর্মীয় ভাবধারায় প্রভাবিত বিশাল আকারের পাথরের মূর্তি গুলো  ভাস্কর্য শিল্পে তাদের শেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে। মিশরীয়দের সর্বশেষ্ঠ  ভাস্কর্য  হচ্ছে গির্জার অতুলনীয় স্ফিংক্স। স্ফিংক্স হচ্ছে  এমন একটি মূর্তি, যার দেহ সিংহের মত, কিন্তু মুখ মানুষের মত ।

লিখন পদ্ধতি ও কাগজ আবিষ্কার

নগর  সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মিশরীয় রিখন পদ্ধতি উদ্ভব করে। পাঁচ হাজার বছর পূর্বে তারা সর্বপ্রথম ২৪ টি ব্যঞ্জনবর্ণের বর্ণমালা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়। মিশরীয় সভ্যতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল লিপি বা অক্ষর আবিষকার। মিশরীয়রা প্রথমে  ছবি একে  মনের ভাব প্রকাশ করত। এই লিখন পদ্ধতির নাম ছিল চিত্র লিপি। মিশরীয়দের  চিত্র লিপিকে বলা হয় ‘হায়রোগ্লিফিক’ বা পবিত্র অক্ষর। মিশরীয়রা নলখাগজ জাতীয় গাছের কান্ড থেকে কাগজ বানাতে শেখে। সেই কাগজের উপর তারা লিখে।

বিজ্ঞান

প্রাচীন মিশরীয়রা মানব সভ্যতার ইতিহাসে গেীরবময় স্থান দখল করে আছে। মানব সভ্যতার অগ্রগতি তাদের অবদানের সমৃদ্ধ। স্থাপত্য ও ভাস্কর্য  তাদের  ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নির্মাতা বলা হয়। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা ছিল কৃষি নির্ভর। মিশরীয়রা প্রাচীন কাল থেকে নীল নদের প্রাবণ, নাব্যতা,পানি প্রবাহের মাপ জোয়ারুটা ইত্যাদি ছাড়াও জমির মাপ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল এসবের সঙ্গে জ্যোতিষশাস্র ও অংক শাস্রের ছিল গভীর যোগাযোগ। মিশরীয়রা তাদের প্রয়োজনের তাগিদে অংক শাস্রের দুটি শাখা – জ্যামিতি এবং পাটিগনতের ও প্রচলন করে। মিশরীয় সভ্যতার মানুষ যোগ, বিয়োগ ও ভাগের ব্যকহার জানত। ৩৬৫ দিনে বছর এ হিসাবের আবিষ্কারক ও তারা। প্রাচীন মিশরের অধিবাসীরা সময় ‍নির্ধারনের জন্য সূর্য ঘড়ি, ছায়াঘড়ি আবিষ্কার করে। 

অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চিকিৎসা করার বিদ্যা ও তাদের জানা ছিল। ধর্মের কারণে মিশরীয়রা বিজ্ঞান চর্চায় আগ্রহী ছিল। মিশরীয়রা চোখ, দাঁত, পেটের রোগ নির্ণয় করতে জানত। মিশরীয়রা হাড় জোড়া লাগানো , হৃৎপিন্ডের গতি এবং নাড়ির স্পন্দন নির্ণয় করতে পারত।

মিশরীয়রা দর্শন, সাহিত্যচর্চা করত। তাদের রচনায় দুঃখ-হতাশার কোনো প্রকাশ ছিল না। মিশরীয়রা আশাবাদী ছিল। তাদের লেখায় সব সময়ই আনন্দের প্রকাশ দেখা গেছে ।

সভ্যতায় মিশরীয়দের অবদান

প্রাচীন সভ্যতায় মিশরীয়দের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই । মিশরীয়রা ধর্মের চিন্তা, শিল্প, ভাস্কর্য, লিখন পদ্বতি, কাগজের আবিষ্কার, জ্ঞান, বিজ্ঞানচর্চা-সবকিছু তাদের অবদানের সমৃদ্ব। মিশরীয়দের অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে যে, তাদের জীবন ধর্মীয় চিন্তা ও বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত ছিল।

সময়কাল

মিশরীয় সভ্যতা ২৫০০ বছরের ও বেশি সময়ব্যাপী স্থায়ী হয়েছিল। মিশরীয়রা  নিজেদের আত্মচেস্টার ফলে অনেক কিছু আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। প্রাচীন মিশরের নিরবচ্ছিন্ন ও দীর্ঘ ইতিহাসের সূচনা হয় ৫০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। বিশেষ করে নবোপলীয় যুগে । 

মিশরীয় সভ্যতার গোড়াপত্তন হয় মেনেসের নেতৃত্বে, যা প্রায় তিন হাজার বছর ধরে স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিল। খ্রিস্টপূর্ব দশম শতকে লিবিয়ার এক বর্বর জাতি ফারাওদের সিংহাসন দখল করে নেয়। মিশরীয়রা ৬৭০-৬৬২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে অ্যাসিরীয়রা মিশরে আধিপত্য বিস্তার করে। মিশরীয়রা ৫২৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পারস্য মিশর দখল করে নিলে প্রাচীন মিশরের সভ্যতার সূর্য অস্তমিত হয়।

গ্রিসের সভ্যতার অবসানের আগেই ইতালিতে টাইবার নদীর তীরে একটি বিশাল সম্রাজ্য ও সভ্যতা গড়ে উঠে। রোমকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই সভ্যতা রোমান সভ্যতা নামে পরিচিত। রোমান সভ্যতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের এই ব্লগটি পড়ুন

Related Posts

Leave a Comment