এই ব্লগটি ব্রিটিশ আমলের ভারতীয় সেনাবাহিনী তথা সিপাহী বিদ্রোহে মঙ্গল পাণ্ডে ভুমিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আমরা আমাদের প্রতিটি ব্লগ তথা সকল ঘটনায় তারিখ এবং সালের উল্লেখ না করে মূল বিষয়ের উপর বেশি গুরুত্ব প্রদান করছি। যাতে মানুষ তারিখ এবং সালের হিসাব করতে গিয়ে ইতিহাসের মূল বিষয়গুলো ভুলে না যায়। ভারতবর্ষে সিপাহী বিদ্রোহ অনেক বৃহৎ আকার ধারণ করে মঙ্গল পাণ্ডের মৃত্যুর পর। ধরা হয় মঙ্গল পাণ্ডে ছিলেন সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম শহীদ। এখন আমরা মঙ্গল পাণ্ডে তথা সিপাহী বিদ্রোহে মঙ্গল পাণ্ডের ভুমিকা নিয়ে সংক্ষিপ্ত বিবরনী তুলে ধরবো।
১৮২৭ সালের ১৯শে জুলাই উত্তর প্রদেশে মঙ্গল পাণ্ডে জন্মগ্রহন করেন। দারিদ্রতা ও গৃহকর্তার অভাবে কিশোর মঙ্গল পাণ্ডে ইংরেজ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেঙ্গল আর্মীতে যোগ দেন মঙ্গল পাণ্ডে। সনাতন ধর্মাবলম্ভী মঙ্গল পাণ্ডে বাস্তব জীবনে ছিলো অতীব ধার্মিক একজন ব্যক্তি। যে কারণে সব ধরনের মানুষ উনাকে সম্মান করতেন এবং ভালবাসতেন। আমরা মূলত মঙ্গল পাণ্ডের জীবনের সেই উল্লেখযুগ্য ঘটনাটি উল্লেখ করার চেষ্টা করছি। তাই তাহার জীবন বৃত্তান্ত সংক্ষেপে সম্পন্ন করেছি। আপনি যদি মঙ্গল পাণ্ডের জীবনী সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক থাকেন তাহলে আপনি এই ব্লগটি পড়তে পারেন।
বিদ্রোহের উৎপত্তি
এখন আসা যাক মূল ঘটনায়। সময়টা ছিলো ১৮৫৭ সালের ২৯শে মার্চ। তখন ইংরেজ শাসন বেশ দাবিয়ে বসেছিলো আমাদের সম্পুর্ন ভারতবর্ষে। দীর্ঘদিন ধরে নানা কারণে সিপাহী তথা ইংরেজ সেনা বাহিনীতে ক্ষুভ জমতে থাকে। ব্রিটিশ উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা প্রতিনিয়তই ভারতীদের অপমান এবং নির্যাতনে ব্যস্ত থাকে। তাদের মধ্যে উল্লেখযুগ্য ছিলো ব্রিটিশ কর্মচারীদের বাধ্য হয়ে সম্মান জানানো, ইংরেজদের নিপীড়ন এমনকি অনেক ইংরেজ দপ্তরের দেওয়ালে তো লেখাই থাকতো “কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ” এরূপ অবস্থা আপনার মানসিক চিন্তাধারা কেমন হবে? যখন আপনি দেখবেন আপনার ঘরে বসে কেউ আপনার সম্পদ লোট করছে এবং আপনাকে কুকুরের সাথে তুলনা করছে। এমনই অবস্থা ছিলো তখনকার সকল ভারতীয়দের মনে।
তবে ইংরেজরা এখানেই শান্ত ছিলো না। তারা ভারতীয়দের ভাতে মারার চিন্তা করেছিলো। একজন ইংরেজ এবং ভারতীয় সিপাহীর বেতনের চাকা ছিলো সম্পূর্ন ভিন্ন। তখন ভারতীয় সৈন্য ও অফিসারের সংখ্যা ছিলো প্রায় ৩ লক্ষ। তাদের মধ্যে ইংরেজ ছিলো প্রায় ৫০ হাজার এবং বাকীরা ভারতীয়। মোট সৈন্যের পিছনে বাজেট ছিলো প্রায় ৯৮ লক্ষ পাউন্ড। যার মধ্যে ৫৬ লক্ষ পাউন্ড খরচ হতো ব্রিটিশ সৈন্যের পিছনে এবং বাকী ৪২ লক্ষ পাউন্ড খরচ করা হতো আড়াই লক্ষ ভারতীয় সৈন্যের পিছনে। এদের একজনের মাসিক বেতন ছিলো মাত্র ৭ রুপি। যুদ্ধে আহত ও নিহত সেনা সদস্যের কোনো দায় ভার ব্রিটিশ সরকার নিতো না। তাও ভারতীয়রা নিরবে তা সহ্য করে নিচ্ছিলো। তবে একটা সময় যখন ভারতীদের নিজেদের মধ্যে দাঙা লাগানোর চেষ্টা এবং তাদের ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত হানে তখন ভারতীয়রা নড়ে বসে।
ধর্মীয় অনুভতিতে আঘাত
তৎকালীন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে মুসলিম এবং হিন্দু যুবক একই সাথে কাজ করতো। সবাই ভারতীয় হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে বেশ ভাল বন্ধুত্ব ছিলো। যা ভাঙ্গার জন্য ব্রিটিশ একটি অভিনব কৌশল প্রস্তুত করে। তখন 53N Fil Rifle এর টোটার সামনের অংশ দাত দিয়ে ছিড়ে বন্দুকে বারুদ প্রবেশ করানো হতো। তবে এখনেই ছিলো ইংরেজের আসল চক্রান্ত। পৃথিবীতে তৈলাক্ত এবং সল্পমূল্যের অনেক চর্বি থাকা সত্ত্বেও ইংরেজরা চালাকি করে ভারতীয়দের অপমান এবং ধর্মী সংঘাত সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে গরু এবং শুকরের চর্বি মিশ্রন করে টোটা প্রস্তুত করেছিল। যা মুসলিম এবং হিন্দুদের ধর্মীয় বিধিতে নিষিদ্ধ ছিলো। এই সংবাদ চাপা থাকেনি বেশিদিন। দিকে দিকে সকল সৈন্যের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। যার প্রধান উদ্যোগ নেন মঙ্গল পাণ্ডে। তিনি এর দৃঢ় বিরোধীতা করেন এবং প্রথম অবস্থায় এই ধরনের টোটা ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে ইংরেজরা নিজেদের সিদ্ধান্তে অটুট থাকে। যার ফলে শুরু হয় ভারতীয় সৈন্যদের সমন্বয়ে এক সাধারণ বিদ্রোহ যা পরবর্তীতে সিপাহী বিদ্রোহে রুপ নেয়।
১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চের বিকেলে, ৩৪তম বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির সেনাপতির সহকারী লেফটেন্যান্ট বৌগ অবগত হন যে ব্যারাকপুরে অবস্থিত তার রেজিমেন্টের বেশ কয়েকজন সিপাহী উত্তেজিত অবস্থায় রয়েছে। তাদের মধ্যে মঙ্গল পাণ্ডে তথা আরও কয়েকজন সিপাহীর হাতে বন্দুক ছিলো। ব্যারাকপুর সেনানিবাসের নিকটবর্তী একটি স্টিমারে আগত ব্রিটিশ সৈন্যদের অবতরণের খবর পেয়ে কোয়ার্টার-গার্ড ভবনে দৌড়ে গিয়েছিলেন। বৌগ অবিলম্বে সশস্ত্র হয়ে ঘোড়ায় চড়ে সেখানে উপস্থিত হন। পাণ্ডে ৩৪তম কোয়ার্টার-গার্ডের সামনে থাকা স্টেশন বন্দুকের পিছনে অবস্থান নেয়ে এবং বাগকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। তবে পাণ্ডে লক্ষভ্রষ্ট হলেও, তার ছোড়া গুলি বাগের ঘোড়াকে আঘাত করেছিল এবং ঘোড়া আরোহী বৌগকে মাটিতে ফেলে দেয়। বৌগ দ্রুত নিজেকে রক্ষা করে এবং একটি পিস্তল জব্দ করে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পাণ্ডের দিকে এগিয়ে গেলেন। তবে তিনিও লক্ষভ্রষ্ট হয়েছিলেন। বাগ তার তলোয়ার বের করার আগেই পাণ্ডে তাকে তলোয়ার দিয়ে আক্রমণ করেছিলেন এবং সেনাপতির সহকারীর নিকটস্থ হয়ে বৌগের কাঁধে ও ঘাড়ে তলোয়ার আঘাত করে তাকে মাটিতে ফেলে দেন। এরপরই অপর সিপাহী শায়খ পল্টু হস্তক্ষেপ করেছিলেন, এবং পাণ্ডেকে বাঁধা দেবার পাশাপাশি নিজের বন্দুকে গুলি ভরার চেষ্টা করেছিলেন।
গুলাগুলির এক মুহুর্তে শেষ হয়ে যায় মঙ্গল পাণ্ডের বন্দুকের গুলি। তখন মঙ্গল নিশ্চিত ছিলেন যে এখন যদি উনি জীবিত থাকেন তাহলে উনাকে এই ইংরেজরা মৃত্যু দন্ড প্রদান করবে অথবা অধিক যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যু দিবে। হয়তো সে কারণেই তিনি নিজের বন্দুকের শেষ গুলিটা ছুড়েন উনার বুকে। দুর্ভাগ্যবসত গুলিটি উনার হৃদপিণ্ডে আঘাত করেনি। যার ফলে আনুমানিক এক সপ্তাহ পড়ে উনার যথাযত চিকিৎসার মাধ্যমে তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন।
মৃত্যদন্ড ও সিপাহী বিদ্রোহের সূচনা
সুস্থ হওয়ার পর শুরু সামরিক আদালতের বিচারকার্য্য। দিনটি ছিলো ৬ এপ্রিল ১৮৫৭। উনার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ মঙ্গল পাণ্ডে স্বীকার করেন এবং এর কারণে উনি কোনো অনুসচনাও জ্ঞাপন করেন না। যার ফলে সামরিক আদালত তার মৃত্যদন্ড প্রদান করে। ১৮৫৭ সালের ৮ এপ্রিল জন সম্মুখে ফাসিতে ঝুলিয়ে মঙ্গল পাণ্ডের মৃত্যদন্ড কার্যকর করা হয়।
ঘটনাটি হয়তো এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। তবে তার বিপরীতে শুরু হয় ইতিহাসের আরও এক অন্যতম অধ্যায়। যাকে আমরা সিপাহী বিদ্রোহ নামে জানি। এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে ভারতের মিরাট দিল্লি সহ আরও বেশ কিছু জায়গায়। তবে সমনে থেকে নেতৃত্ব প্রদানকারীর অভাবেই হয়তো এই বিদ্রোহ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
কে এই ক্ষুদিরাম বসু, কেন তাকে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই ঝুলতে হয় ফাঁসির কাষ্ঠে, কেনইবা তার প্রতি অজস্র মানুষের এতো ভালোবাসা। ক্ষুদিরাম বসু সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের এই ব্লগটি পড়ুন।
2 comments
wowo what a great story
Thanks