মোগল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট সম্রাট আকবর। ১৫৪২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই অক্টোবর অমরকোট নামক স্থানে করেন। ১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দে মোগল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট হুমায়ুন -এর মৃত্যুর পর, তাঁর বড় ছেলে আকবর সিংহাসনে বসেন। আকবর এর মায়ের নাম হামিদা বানু।
দিল্লীর সিংহাসন দখল
১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ-এর কাছে হুমায়ুন-এর পরাজয়ের হওয়ার পর, হুমায়ুন আশ্রয়ের জন্য অনেক স্থান ঘুরে অমরকোটে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে আকবরের জন্ম হয়। হুমায়ুন পলায়নের সময় পাকিস্তানের পশ্চিমার লোকদের কাছে জানতে পারেন যে, তাঁর ভাই আশকরী পথে আক্রমণ করতে পারেন। তাই তিনি আকবর এবং তাঁর মা হামিদা বানুকে অমরকোটে রেখে একাই পাকিস্তানের পশ্চিমে পথে চলে যান। কিন্তু আশকরী আকবর এবং তাঁর মা হামিদা বানুর সন্ধান পাওয়ার পর সযত্নে আশ্রয় দেন। ১৫৪৫ খ্রিষ্টাব্দে হুমায়ুন দক্ষিণ আফগানিস্তানের একটি শহর এবং পূর্ব-মধ্য আফগানিস্তানের একটি শহর উদ্ধার করার পর, তিনি পরিবার পরিজনকে উদ্ধার করেন। ১৫৫১ খ্রিষ্টাব্দে হুমায়ুন-এর অপর ভাই হিন্দোলের মৃত্যুর পর, আকবরবকে আনুষ্ঠানিকভাবে গজনীর(বর্তমান আফগানিস্তানের গজনি প্রদেশ) শাসনকর্তা করা হয়। ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দে হুমায়ুন দিল্লীর সিংহাসন দখল করার পর, আকবরকে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা করা হয়। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে আকবর সিংহাসনে বসেন, হুমায়ুন-এর মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে। এই সময় আকবরের অভিভাবক হিসেবে বৈরাম খান ছিলেন।
আকবরকে দিল্লীর সিংহাসন থেকে অপসারিত করার জন্য, মহম্মদ শাহ আদিলের সেনাপতি হিমু বিশাল সেনাদল নিয়ে আগ্রা(ভারতীয় উপমহাদেশের দুর্গ) অভিমুখে রওনা দেন এবং সহজেই আগ্রা দখল করেন। এরপর তিনি দিল্লী দখলের উদ্দেশ্যে যাত্রা দিলে, দিল্লীর সেই সময়ের শাসনকর্তা তার্দিবেগ তাঁকে বাধা দেন। কিন্তু তিনি পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন। ফলে দিল্লী হিমুর দখলে চলে আসে। হিমু বিক্রমাদিত্য নাম ধারণ করে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেন। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে হিমুকে জব্দ করার জন্য, বৈরাম খান দিল্লীর পথে যাত্রা শুরু করেন। উভয়ে মিলিত হন পাণিপথে। ইতিহাসে এই যুদ্ধকে পাণিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ বলা হয়। এই যুদ্ধে হিমুর হস্তিবাহিনী বৈরাম খানের বাহিনীকে প্রায় বিপর্যস্ত করে ফেলে। মোগল বাহিনী বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু চোখে তীরবিদ্ধ হিমু সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে, নেতৃত্বের অভাবে হিমুর বাহিনী অসহায় হয়ে পড়ে। এই সময় বৈরাম খান সুযোগ বুঝে হিমুকে বন্দী করেন। এই সময়, বৈরাম খান প্রায় ২৫০০ হাতি সহ বিপুল পরিমাণ যুদ্ধের হাতিয়ার উদ্ধার করতে সক্ষম হন। এরপর বৈরাম খান আহত হিমুকে হত্যা করে, দিল্লীর রাজপথে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে রাখে।
সম্রাট আকবর এর বিবাহ
১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দে আকবর মধ্য-প্রদেশের একটি প্রাচীন অতিমহাদেশের রাজ্য দখলের জন্য আসফ খাঁকে পাঠান। এই সময় প্রাচীন অতিমহাদেশের রানী দুর্গাবতী তাঁর নাবলক পুত্র বীরনারায়ণের অভিভাবকরূপে রাজত্ব করতেন। এই যুদ্ধে রানী দুর্গাবতী পরাজয় হন পরাজয়ের পর আত্মহত্যা করেন, যার ফলশ্রুতিতে এই রাজ্য আকবরের দখলে আসে। এই বৎসরেই মালবের বিদ্রোহী শাসনকর্তা আব্দুল্লাহ খাঁ উজবেকে দমন করার জন্য আকবর মালব-অভিযানে বের হন যাত্রা পথে খান্দেশ রাজ্যের শাসক মীরন মুবারকের সাথে তাঁর সরাসরি যোগাযোগ হয়। তিনি মীরন মুবারকের কন্যাকে আকবরের পছন্দ হয় এবং বিবাহের প্রস্তাব দেন। পরে এই বিবাহ সম্পন্ন হয়। এই বৎসরে (১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি হিন্দুদের উপর থেকে জিজিয়াকর (জিজিয়াকর হলো ইসলামি রাষ্ট্রে ইসলামি আইনের অনুকূলে স্থায়ীভাবে বসবাসরত অমুসলিমদের জনপ্রতি বাৎসরিক ধার্যকৃত কর।)তুলে নেন।
আকবর চিতোর আক্রমণ করেন ১৫৬৭ খ্রিষ্টাব্দে চিতোর মেবারের রাজধানী। মেবারের রাজা রাণা উদয় সিংহ আকবরকে ঘৃণার চোখে দেখতেন এবং তিনি মালবের রাজা বাজবাহাদুরকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তাছাড়া গুজরাটে আক্রমণ পরিচালনার জন্য চিতোর দখল করাটা জরুরি ছিল। আক্রমণের প্রথম দিকে উদয় সিংহ পালিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় নেন। কিন্তু জয়মল এবং পত্ত নামক দুই জন মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন প্রায় চার মাস ব্যাপী।সেনাপতিদ্বয় যুদ্ধে নিহত হলে, দুর্গের ভিতরের থাকা সুন্দরী নারী অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করেন। ১৫৬৮ খ্রিষ্টাব্দে চিতোর রাজ্য আকবরের দখলে আসে। আসফ খাঁকে মেবারের শাসনকর্তা নিয়োগ করা হয়।
১৫৬৯ খ্রিষ্টাব্দে আকবর রথোম্ভর রাজ্য আক্রমণ করেন। যুদ্ধে রাজপুত রাজা সারজন্হারা পরাজিত হয়ে বন্ধুত্ব প্রার্থনা করেন। এবং তাঁর দুই পুত্র ভোজ ও দুদাকে মোগল দরবারে পাঠান। সারজন্হারাকে পরে ভবারানসী ও চুনারের রাজা করা হয়। পরবর্তীতে কালিঞ্জর দখলের জন্য আকবর সৈন্য নিয়োগ করেন। কালিঞ্জরের রাজা বিনা বাধায় আত্ম সমর্পণ করেন। পরে কালিঞ্জরের রাজাকে এলাহাবাদের কাছে জায়গির দেওয়া হয় এবং কালিঞ্জরের শাসনভার দেওয়া হয় সেনাপতি মাজনুর খাঁর হাতে।
আকবর দ্বিতীয় বিবাহ করেন বিকানীর রাজকন্যাকে ১৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে।
সমবেত ধর্ম "দীন-ই-ইলাহি ও ইলাহি সন"
১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে আকবর খান্দেশ রাজ্যে আক্রমণ চালান এবং সেই সময়ে খান্দেশের শাসক ছিলেন রাজা আলি খাঁ। মোগল বাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়ে, তিনি প্রচুর অর্থ প্রদান করে মোগলদের নির্ভরতা স্বীকার করেন। খান্দেশ মোগলদের সাহায্যকারী রাজ্যে পরিণত হয়।
এরপর আকবর কাবুলের দিকে নজর দেন। ১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কাবুলে সামরিক অভিযান চালান এবং বিনা বাধায় কাবুল দখল করেন। কিন্তু মীর্জা হাকিমের আকবরের অধীনতা অস্বীকার করলে, আকবর মীর্জা হাকিমের বোনের হাতে কাবুলের শাসনভার দিয়ে দিল্লীতে ফিরে আসেন। এরপর তিনি দীর্ঘদিনের চিন্তা প্রসূত দীন-ই-ইলাহী নামে একটি ধর্মমত প্রচারের উদ্যোগ নেন।
১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে আপন পুত্র জাহাঙ্গীরের বিবাহ দেন বিহারীমলের পুত্র ভগবান দাসের কন্যার সাথে ।
দীন-ই-ইলাহি ও ইলাহি সন
১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বৎসরে আকবর একটি সমবেত নতুন ধর্ম প্রচারের উদ্যোগ নেন। এই ধর্মের নাম দেওয়া হয়েছিল দীন-ই-ইলাহি বা তৌহিদ-ই-ইলাহি। এই ধর্মের আদর্শে তিনি মুদ্রা থেকে কালিমা তুলে দেন। মুদ্রা ও শিলালিপি থেকে আরবি ভাষা তুলে দিয়ে ফারসি ভাষার প্রবর্তন করেন। একই সাথে তিনি আরব দেশীয় চান্দ্র মাসের পরিবর্তে পারস্যের সৌর বৎসরে প্রচলন করেন। বর্তমান অবস্থায় এই বৎসর-গণন পদ্ধতির নাম দেওয়া হয় তারিখ-ই-ইলাহি বা সন ই ইলাহি। এই ইলাহি সনকে ভারতবর্ষের আদর্শে নতুন করে সাজানোর জন্য দায়িত্ব অর্পণ করা হয় আকবরের সভার রাজ জ্যোতিষী আমির ফতেউল্লাহ শিরাজীর উপর ৯৯২ হিজরি সনে।
আকবর সিংহাসনে আরোহণ করেন ৯৬৩ হিজরি সনের রবিউল আখির মাসের ২ তারিখে [১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ]। হিজরি সনের মর্যাদা দেখিয়ে, ৯৬৩ সংখ্যাকে ইলাহি সনের প্রথম বৎসরের মর্যাদা দেন। এর পরবর্তী বৎসর থেকে পঞ্জিকা ভিত্তিক বর্ষপঞ্জি হিসাবে গণনা শুরু করেন। এই সূত্রে হিজরি চান্দ্র-মাস তুলে দিয়ে সৌরমাস গণনা শুরু করেন। আকবর এই নতুন বর্ষ-গণন পদ্ধতি প্রচলনের আদেশ জারি করেন ৯৯২ সালের ৮ই রবিউল তারিখ, খ্রিষ্টাব্দের হিসাবে এই তারিখ ছিল ১০ মার্চ ১৫৮৫। যদিও আকবরের সিংহাসন আরোহণের দিন থেকে ইলাহি বর্ষের শুরু হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কার্যত দেখা গেল, পারস্যের পঞ্জিকা অনুসারে বৎসর শেষ হতে ২৫ দিন বাকি রয়ে যায়। তাই ইলাহি সন শুরু হলো– আকবরের সিংহাসন আরোহণের ২৫ দিন পর। এই নির্দেশানুসরে বিষয়টি কার্যকরী হয়– ২৮ রবিউল আখের ৯৬৩ হিজরী, ১১ মার্চ, ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ।
ইলাহি সনের প্রথম দিনটিকে নওরোজ (নতুন দিন) হিসাবে গৃহীত হয়েছি প্রাচীন পারস্যের রীতি অনুসারেল। এছাড়া ইলাহি সনের মাসগুলোর নাম গ্রহণ করা হয়েছিল প্রাচীন পারস্যের পঞ্জিকায় প্রাপ্ত নামগুলো থেকে। পারস্যের এই মাসগুলোর নাম ছিল- ফারওয়ারদীন (فروردین), আর্দিবিহশ্ত (اردیبهشت), খুরদাদ (خرداد), তীর (تیر), মুরদাদ (مرداد), শাহরীয়ার (شهریور), মেহ্র (مهر), আবান (آبان), আজার (آذر), দে (دی), বাহমান (بهمن) এবং ইসপন্দর (اسفند)। এই নামগুলো বঙ্গাব্দ কেন কোনো ভারতীয় সংবৎ-এর সাথে যুক্ত হয় নি।
সম্রাট আকবর পারস্যের সৌরবৎসরের অনুকরণে যে ইলাহি সন প্রবর্তন করেছিলেন, তা ছিল সর্বভারতীয় রাষ্ট্রীয় সন। কিন্তু এই সন ধরে একই সময়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজস্ব আদায় করাটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ রাজস্ব আদায়ের জন্য, সম্রাটকে কৃষকের ফসল ঘরে উঠার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। ভারতবর্ষের মতো বিশাল দেশে একই সময় সকল স্থানের কৃষকরা ফসল কাটতো না। সেই কারণে ফসল কাটার সময়কে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে পৃথক পৃথক সনের প্রচলন করা হয়েছিল। এই বিচারে ফসলি সন হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ফসল-নির্ভর আঞ্চলিক বর্ষ গণন পদ্ধতি। এই কারণে তৎকালীন বঙ্গদেশে ফসলি সনের শুরু হতে অগ্রহায়ণ মাস থেকে। পক্ষান্তরে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে ফসলি সন শুরু হতো আষাঢ় মাস থেকে। তবে এই সকল ফসলি সনগুলো ছিল সৌর-বৎসর ভিত্তিক ইলাহি সন।
১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবর মৃত্যু বরণকরেন।
ঈসা খাঁ বাংলার বারো ভুঁইয়া বা প্রতাপশালী বারোজন জমিদারদের অন্যতম। ঈসা খাঁ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের এই ব্লগটি পড়ুন।