শায়েস্তা খান

সুবেদার শায়েস্তা খান এর জীবনী

by Sayedur Rahman

১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে শায়েস্তা খান জন্মগ্রহণ করেন। এঁর পিতা আসফ খান ছিলেন ইরানি বংশোদ্ভূত। আসফ খান-এঁর কন্যা মমতাজ মহল-এর সাথে সম্রাট শাহজাহান-এর বিবাহের পর, শাহজাহান আসফ খানকে উজির বা প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োজিত করেন। বৈবাহিক সূত্রে সম্রাট শাহজাহানের শ্যালক  ছিলেন শায়েস্তা খান।

শিবাজীর সাথে সামনাসামনি যুদ্ধ

১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে দাক্ষিণ্যাতের শিবাজীকে পরাজিত করার জন্য শায়েস্তা খানকে নিযুক্ত করেন আওরঙ্গজেব। শায়েস্তা খান পুনেতে গৃহ স্থাপন করেন এবং দৃঢ় নিরাপত্তা ঘেরাও মহলে প্রবেশ করেন। পুনে শহরে কোন মহারাষ্ট্রের অধিবাসী ব্যক্তির প্রবেশাধিকার ছিল না। হটাৎ একদিন একটি বিবাহ অনুষ্ঠানের জন্য আনন্দ পালনের উদ্দেশ্যে বিশেষ অনুমতি গ্রহণ করে শিবাজী এবং তার বাহিনী বরপক্ষ সেজে পুনেতে প্রবেশ করে।প্রহরীদের হত্যা করার পর দেওয়াল ভেঙ্গে তারা ঘরে প্রবেশ করে। শিবাজী নিজেই শায়েস্তা খান এর মুখোমুখি হন এবং শিবাজীর তরবারির আঘাতে তার  তিনটি আঙ্গুল কেঁটে যায় বৃদ্ধাঙ্গুলসহ। শায়েস্তা খাঁকে পরবর্তীতে সে জায়গা থেকে উদ্ধার করে একটি নিরাপদ স্থানে পৌছে দেন তার আশ্রিত কর্মীরা। পুনের ঘটনায় অসন্তোষ হয়ে আওরঙ্গজেব শায়েস্তা খাঁকে দুরবর্তী স্থান বাংলায় প্রেরণ করেন।

আরকানদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ

বাংলায় পদার্পনের ফলে শায়েস্তা খানকে  দুর পাহাড়ী বিদ্রোহী উপজাতীয়দের শাসন করতে দেখা যায়। শায়েস্তা খান আরাকান রাজাকে অনেক হুমকি হিসেবে গণ্য করেছিলেন কারণ তারা সেনা ও নৌ শক্তিতে উন্নত ছিল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মুঘল নৌ-বাহিনীর উন্নয়ন শুরু করেন। এক বছরে নৌ-বহরের সংখ্যা প্রায় ৩০০ পৌছে। তিনি ডাচ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি এবং সেই সাথে পর্তুগালের আস্ত অর্জনের জন্য কূটনৈতিক প্রয়াস চালান। ডাচ্ সেনাবাহিনীর সরাসরি সহযোগিতায় শায়েস্তা খান আরাকানদের দখলে থাকা সন্দ্বীপ আক্রমণে মুঘলদের নেতৃত্ব দেন। আরাকান ও পর্তুগিজদের পূর্ব থেকেই দ্বন্দ্ব ছিল যার ফলশ্রুতিতে শায়েস্তা খাঁ এক লক্ষণীয় সুবিধা লাভ করেন।

১৬৬৫ সাল এর ডিসেম্বরে শায়েস্তা খান এক গুরুত্বপূর্ণ সেনা প্রচারণা চালু করেন চট্টগ্রামের বিরুদ্ধে, চট্টগ্রাম তখন ছিল আরাকানদের রাজধানী। সেখানে সাগরে এবং পরবর্তীতে কর্ণফুলীতে প্রচণ্ড নৌ-যুদ্ধ সংগঠিত হয়, যাতে পর্তুগিজদের সহায়তায় মুঘলরা বিজয় লাভ করে। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আরাকানী নৌবাহিনীর কিছু সৈন্য পালিয়ে যায় এবং কিছু দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু সেই দুর্গটি ১৬৬৬ সালের ২৬শে জানুয়ারি শায়েস্তা খাঁ দখল করেন। তার ই ধারাবাহিকতায় ​কুচবিহার ও কামপূরায় মুঘল সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন

আরাকানদের বিরুদ্ধে বিজয় হওয়ার পর তিনি কয়েক হাজার কৃষকদের মুক্তি দানের নির্দেশ দেন। শাসনকর্তা হিসেবে তিনি ইউরোপ, দক্ষিণ পূর্ব এশীয় ও ভারতের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি ইউরোপীয়দের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে তার অবস্থান সুদৃঢ় করেন।

শায়েস্তা খাঁ নির্মিত মসজিদ

শায়েস্তা খাঁ আমলে টাকায় আট মণ চাল কিনতেপাওয়া যেত। কিন্তু আমরা কি জানি ঢাকার উন্নয়নে শায়েস্তা খাঁ অনেক অবদান রয়েছে? ঢাকায় শায়েস্তা খাঁ নিজেই তৈরি করেছেন অনেক স্থাপনা আর মসজিদ। তাঁর তৈরি প্রথম মসজিদের নাম শায়েস্তা খাঁ মসজিদ। মিটফোর্ড হাসপাতালের পেছানটায় লোকচক্ষুর প্রায় পিছন দিকে মসজিদটি।

ঢাকায় শায়েস্তা খাঁ যেসব ভবন, মসজিদ বা মন্দির তৈরি করেন সেসবের মধ্যে এ মসজিদই প্রথম। ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি স্থাপন করা হয় তখনকার কাটরা পাকুড়তলী নামক স্থানে। যেখানে বর্তমানে মিটফোর্ড হাসপাতাল গড়ে উঠেছে, তারই প্রাচীন নাম এটি।  মসজিদের পাশে বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে তোলা হয়েছিলে শায়েস্তা খাঁর রাজভবন যার কোনো চিহ্ন বর্তমানে নেই। ৩৭.৮ ফুট দৈর্ঘ্য আর ১৬.৮ ফুট প্রস্থের মসজিদটিতে মোট পাঁচটি আলংকরিক মেহরাবে খিলানযুক্তভিতরে যাওয়ার রাস্তা ছিল। পরবর্তীকালে উত্তর ও দক্ষিণ দিকের দুটিকে জানালা বানিয়ে পুর্বদিকের তিনটি প্রবেশপথ রাখা হয়েছে।

​সিপাহী  বিপ্লবের সময় ১৮৫৭ সালে অগ্নিকাণ্ডে মসজিদটি  ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকারের পূর্ত বিভাগ এ মসজিদটিকে মেরামত করেন। মসজিদটির উত্তর পাশে শাহজাদী খানম নামে শায়েস্তা খাঁর এক মেয়ের কবর ছিল। পরবর্তীকালে নতুন ভবন নির্মাণ করার ফলে ​কবরটি অপসারণ করা হয়।

শায়েস্তা খান আমলে ঢাকা

শায়েস্তা খাঁর আমলে ঢাকা ছিলো মসলিনের জন্য বিখ্যাত। হল্যাণ্ডের অধিবাসীরা ঢাকা থেকে এই বস্ত্র ইউরোপ আর এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করতো। কিন্তু সবচেয়ে ভালো মসলিন তিনি রাজপরিবার এবং শাসনকর্তাদের ব্যবহারের জন্য রাখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং এই উদ্দেশ্যে একজন কর্মচারীও নিয়োগ করেছিলেন।

তবে রাজস্ব আদায়ে শায়েস্তা খা ছিলেন  দৃঢ়। তিনি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বছরে তিন হাজার টাকা কর আদায় করতেন। জনগণের কাছ থেকেও কর আদায় বৃদ্ধি পায় তার আমলে। শায়েস্তা খানের শাসনওবস্তায় মোট জাতীয় উৎপাদের ৪৩.৮% থেকে ৬৪% সংগ্রহ করা হয়েছিলো রাজস্বখ্যাত থেকে। অনেকেই বলে থাকেন, এর ফলে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায় এবং জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়। তবে শায়েস্তা খাঁ কোম্পানির ব্যাপারে কঠোর হলেও জনগণের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর আদায় না করার উদ্যেশেও ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। 

শেষ জীবনে শায়েস্তা খাঁ

ইংরেজসহ সব ইউরোপীয় বণিকদের শায়েস্তা খাঁ ‘অননুমত প্রবেশকারী হিসেবে  মনে করতেন। বিশেষ করে, তার শাসনামলের শেষের দিকে ইংরেজদের সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার আগ্রহ দেখে তাদের উপর উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। তাই ইংরেজদের লিখিত ইতিহাসের অনেকক্ষেত্রেই তাকে ‘স্বেচ্ছাচারী’ আর ‘বুদ্ধিভ্রষ্ট বৃদ্ধ নওয়াব’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে যথাযথভাবে শাসক, সাহসীকথার সাথে যুদ্ধ পরিচালক হিসেবে তার খ্যাতি ছিলো বাংলার মানুষের মুখে মুখে। তার সময়ে ঢাকা ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়। জলদস্যু বিতাড়িত হওয়ায় আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে পূর্ব বাংলার সোনালী সময়ের শুরু হয়। ঢাকায় ইংরেজদের প্রভাব প্রতিপত্তির বিকাশ শুরু হয়েছিলো তার আমলেই। ঢাকার স্থাপত্যকলাও তার সময়ে প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলো। প্রিয়তম কন্যা পরীবিবির সমাধি সৌধ ছাড়াও তার আমলে নির্মিত হয়েছে ছোট বড় অসংখ্য মসজিদ। ঢাকার বুকে এখনও শায়েস্তা খানের স্মৃতি আছে উজ্জ্বল হয়ে আছে।   

শায়েস্তা খানের বিদায়ের দিনে দেওয়া নির্দেশটি পশ্চিম সদর দরজা আটকে দেওয়া হয়েছিলো। বন্ধ দরজা পুনরায় খুলেছিলো চল্লিশ বছর পরে। সরফরাজ খানের শাসনামলে চালের দাম আবার পূর্বের স্তরে নেমে এসেছিলো। ঢাকা থেকে বিদায়ের পর আগ্রায় বিশ্রামের সিদ্ধান্ত নেন শায়েস্তা খাঁ। সেখানেই ৯৪ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তিনি পরপারে চলে গেলেও তার কিংবদন্তি আজও বেঁচে আছে ঢাকার মানুষের মুখে মুখে। 

ঈসা খাঁ বাংলার বারো ভুঁইয়া বা প্রতাপশালী বারোজন জমিদারদের অন্যতম। ঈসা খাঁ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের এই ব্লগটি পড়ুন।   

Related Posts

Leave a Comment