এখন আমরা প্রাচীন বাংলার একটি অন্যতন জনপদ হরিকেল জনপদের ইতিহাস এবং আধুনিক সভ্যতায় এর অবস্থান সম্পর্কে জানবো। প্রাচীন বাংলায় বেশ কিছু জনপদের মধ্যে চন্দ্রদ্বীপ, বঙ্গ, হরিকেল জনপদ, সমতট, ইত্যাদি বিবরন পাওয়া যায়। বর্তমানে আমাদের পাঠ্যবয়ের তারিক এবং অবস্থানের বিশাল তালিকার মাঝখানে আমরা ইতিহাসের আসল রহস্য ভুলতে বসেছি। আমাদের মধ্যে অনেকেরই এই হরিকেল জনপদ সম্পর্কে তেমন একটা ধারনা নেই। তাই আমি এই ব্লগে চেষ্টা করছি তারিখ এবং অবস্থানের অধিক উল্লেখ ব্যতীত হরিকেল জনপদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার।
সপ্তম শতকের উল্লেখযুগ্য কিছু লেখকের বর্ননায় হরিকেলের আংশিক বিবরন পাওয়া যায়। পরবর্তীতে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এর অবস্থান নির্দেশ করেছেন পূর্বভারতের পূর্বসীমায়। বিষয়টি দুঃখজনক হলেও সত্য যে ইতিহাসে এর তেমন একটা বিবরন বা এর অবস্থান সম্পর্কে সঠিক বর্ননা পাওয়া যায়নি। তাই এই সভ্যতাটি যাতে ইতিহাসের পাতা থেকে সম্পুর্ন বিলুপ্ত হয়ে যায় সে কারণেই আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। বর্তমান সভ্যতা এবং অবস্থান অনুসারে হরিকেল জনপদটি বাংলার সিলেট থেকে চট্টগ্রাম এলাকে জুরে বিস্তৃত ছিল। যদিও অন্য সকল সভ্যতার মতো এই হরিকেল সভ্যতার সত্যতা যাচাই করার জন্য কোনো প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যায় না। তাই আমাদের হাতে যতটুকু সত্য ইতিহাস ছিলো তাই আমরা উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি।
যদি আমরা প্রাচীন বাংলার মানচিত্রের দিকে লক্ষ করি তাহলে আমরা এর পূর্বের অবস্থান অনুসারে বর্তমান আধুনিক অবস্থানের সাথে তুলনা করতে পারি। উপরের প্রাচীন বাংলার মানচিত্র অনুসারে পুণ্ড্র, গৌড়, বরেন্দ্র, বঙ্গ, সমতট, চন্দ্রদ্বীপের পাশাপাশি হরিকেলের দুইটি অবস্থানের উল্লেখ পাই। যা বর্তমানে বাংলাদেশের সিলেট এবং চট্টগ্রাম এই দুই অঞ্চল জুরে হরিকেলেন অবস্থান ছিলো।
হরিকেল জনপর সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু তথ্য
প্রাচীন বাংলার যে কয়েকটি জনপদ রয়েছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন এবং উন্নত একটি জনপদ ছিলো হরিকেল। প্রাচীন ভারত মহাদেশে স্বর্ন, রৌপ্যের অধিক উল্লেখ পাওয়া যায়। যাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন দুইটি অংশ ছিলো অলংকার এবং মুদ্রা। একই ধারাবাহিকতায় হরিকেলেও রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন ছিলো। অবশ্য প্রাচীন ভারতের প্রতিটি অঞ্চলের জীবন ব্যবস্থা অভিন্ন থাকার কারণে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আঞ্চলিক আইন, শাসন ব্যবস্থা, মুদ্রা ব্যবস্থা পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হয়। তবুও বঙ্গ সরবরে সকল দ্বীপ বা জনপদ গুলোর মধ্যে সবচেয়ে উন্নত জনপদটি ছিলো হরিকেল। বর্তমানেও হরিকেল জনপদের প্রচলিত মুদ্রা এখন বিদ্যমান রয়েছে যা বাংলাদেশের জাতীয় যাদুঘরের রক্ষিত, সপ্তম থেকে নবম শতকের হরিকেল রাজ্যের রৌপ্যমুদ্রা । এর একদিকে উৎকীর্ণ ত্রিশূল, অন্যদিকে শিবের ষাঁড় নন্দী। ভারতীয় অঞ্চলে সনাতন বা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জনসংখ্যা অধিক হওয়ার কারণে এই অঞ্চলের জীবন ব্যবস্থায় এর নিদর্শন দেখা যায়। যে কারণেই হরিকেলের মুদ্রায় উৎকীর্ণ ত্রিশূল এবং অন্যদিকে শিবের ষাঁড় নন্দী।
ধারনা করা হয়, প্রাচীন নাগরী বর্নমালা এবং ভাষা হরিকেল জনপদের মানুষ ব্যবহার করতো। তবে এর যথাযত কোনো প্রমান না থাকায় নাগরী ভাষাকে কেবল শ্রীহট্ট বা সিলেটের প্রাচীন ভাষা হিসেবেই পরিচিত প্রদান করা হয়।
হরিকেলের মানুষের জীবনযাপন
প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস সম্পর্কে যদি আমরা জানি তাহলে একটি বিষয় অবশ্যই সবার জ্ঞাত আছে যে এই অঞ্চলের মানুষ সাধারনত কৃষ্ণবর্নের অথবা বাদামীবর্নের হয়ে থেকে। একইভাবে হরিকেল জনপদের মানুষও বাদামীবর্নের ছিলো। যাদের জীবিকার মূল উৎস ছিলো কৃষি কাজ। তা ছাড়া বন্য পশু শিকার করাও ছিলো আমিষের যোগান দাতা। রৌপ্য মুদ্রা ব্যবহার করে বিনিময় এবং লেনদেন সম্পন্ন হতো। তখন পর্যন্ত রাজা শাসিত ব্যবস্থা ছিলো বিদ্যায় অনুরুপভাবে হরিকেলেও একই নীতি অনুসরন করা হতো। প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন ধর্মের উল্লেখ পাওয়া গেলেও সনাতন ধর্মের অধিক মানুষ ছিলো বাংলা প্রদেশে। যা বহু শতাব্দী থেকে আজও বিদ্যমান। অনুরুপভাবে হরিকেলেও সানতন ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে তাদের রীতি নীতি, সংস্কৃতি এবং জীবন ধারা অনেকটা ধর্মীয় রীতি অনুসরন করেই মানা হতো।
ততকালীন শিক্ষা হিসেবে বলতে ধর্মীয় শিক্ষার অধিক প্রচলন ছিলো না। ধর্মীয় শিক্ষা মানে ধর্মে রীতি নীতি, বাধ্যবাদকতা, ইত্যাদির শিক্ষা প্রদান করা হতো। তা ছাড়া কোনো প্রাতিষ্ঠানির শিক্ষা ব্যবস্থা তখন পর্যন্ত শুরু না হওয়ার কারণে ব্যক্তিগত শিক্ষার প্রভাব ছিলো বেশি।
ধর্মীয় উপাসনালয়
সনাতন ধর্ম বা হিন্দু ধর্মের উপাসনালয় অনুসারে বিভিন্ন দেবতাদের প্রতিমা মন্দিরে স্থাপনের মাধ্যমে তাদের উপসনা করা হতো। হরিকেল সভ্যতায়ও একইভাবে সনাতন ধর্মীয় নীতি অনুসরন করে দেবতাদের উপাসনা করা হতো। বর্তমান সময়ের সনাতন ধর্মে মতো পূর্বেও মহাদেব তথা অন্য সকল দেবতাদের পুজা করা হতো। তবে প্রাচীন বাংলায় দেবী শক্তির আরাধনা একটি বেশিই ছিলো। ভাল মন্দ সকল বিষয়ের জন্য অনেকেই দেবী শক্তির ব্যবহার করতো। ততকালীন বৃত্তবানরা নিয়ম করে দেবী কালী, তারা, মনষা দেবীর আরাধনা করতো। তাদের মধ্যে অনেকে বাৎসরিক তারিখ অথবা চন্দ্রমাস হিসাব রেখে বিভিন্ন পশুর বলি প্রদান করতো। তবে তখন থেকেও কাপালিকদের অবস্থান অটুট ছিলো। কাপালিক সম্পর্কে আমরা মুটামুটি অনেকেই জানি। ভাল খারাপ দুই ধরনের কাপালিকের মিশ্রন ছিলো ততকালীন হরিকেল জনপদেও।
জনপদের বিলুপ্তি
হরিকেল তথা অন্য সকল সভ্যতার ক্ষেত্রে বিলুপ্তি শব্দটা ব্যবহার করা খানিক অযৌক্তি। কারণ বর্তমান আধুনি সভ্যতার অবস্থান অনুসারে যদি কোনো প্রচীন সভ্যতা থাকে তাহলে তা বিলুপ্ত হয়নি। কেবল পরিবেশ, শাসন এবং নামের পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। হরিকেল সভ্যতারও বিলুপ্তি সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এর সত্যতা যাচাই করার জন্য কিছু বাস্তব তথ্য পাওয়া গেছে যা হরিকেলের বিবরনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন। দিয়াঙ্গ শৈলশ্রেণির পাদদেশে ঝেওয়ারী গ্রামে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে ৬৪টি উৎসর্গীকৃত তাম্রমূর্তি, ২টি বৌদ্ধসতূপের অংশবিশেষ পাওয়া গেছে। ধারণা করা হয় ঝেওয়ারী ভাণ্ডারটি দিয়াঙ্গের প্রাচীনত্ব এবং সমতট ও আরাকানের সাথে এর প্রাচীন সংযোগের ইঙ্গিত বহন করে।
প্রাচীন বাংলার আরও একটি অন্যতম জনপদের উল্লেখযুগ্য হলো চন্দ্রদ্বীপ। স্বাভাবিকভাবেই এই প্রাচীন জনপদ সম্পর্কে তেমন একটি তথ্য একইসাথে পাওয়া যায় না। তাই আমরা আরও একটি ব্লগ লিখেছি প্রাচীন বাংলার এই উল্লেখযুগ্য জনপদটি সম্পর্ক। চুন্দ্রদ্বীপ জনপদ সম্পর্কে জানতে আমাদের এই ব্লগটি পড়ে আসতে পারেন।
তথ্য সূত্রঃ
বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদিপর্ব)
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।