সাইফুর রহমান

অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান এর জীবনী

by Sarwar Husain

সাইফুর রহমান (৬ অক্টোবর ১৯৩২-৫ সেপ্টেমম্বর ২০০৯) বাংলােদেশের একজন অর্থনীতিবিদ এবং রাজনীতিবিদ। যিনি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সর্বোচ্চ ১২ বার বার্ষিক অর্থ বাজেট পেশকারী অর্থমন্ত্রী। তিনি বাংলাদেশের জাতীয়বাদী দলের একজন নেতা ছিলেন যিনি সর্বোচ্চ সময়কালীন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অসম্ভব মেধাবী, সৎ এবং দেশপ্রেমিক। তিনি পেশায় একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট ছিলেন।

জন্ম

এম. সাইফুর রহমান ৬ অক্টোবর ১৯৩২ সালে তৎকালীন মৌলভীবাজার মহকুমার সদর উপজেলার বাহারমর্দ্দন গ্রামে  জন্ম গ্রহন করেন । তার শিক্ষানুরাগী পিতা আব্দুল বাছিত একজন পেশাদার শিক্ষক ছিলেন এবং তার শিক্ষানুরাগী মাতা তালেবুন্নেসা। পরিবারের তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়। মাত্র ছয় বছর  বয়সে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন তার শিক্ষাবিদ পিতা। তিন পুত্রকে নিয়ে দু’চোখ অন্ধকার দেখেন সাইফুর রহমানের জননী বেগম তালেবুন্নেসা। বালক সাইফূর রহমানের পরিবারের এই কঠিন সময় ও ক্রান্তি কালে শিক্ষানুরাগী চাচা মো: সফি আন্তরিক ভাবে এগিয়ে আসেন। নিজ সন্তানের মতই তিন এতিম ভ্রাতুষ্পুত্রের শিক্ষা দীক্ষার দায়িত্ব ভার গ্রহন করেন। তিনি তার চাচা মোহাম্মদ সফির তত্বাবাধানে বড় হয়েছেন।

শিক্ষাজীবন

সাইফুর রহমান শিক্ষাজীবন শুরু করেন মৌলভীবাজার সরকারি হাই স্কুল থেকে। তিনি ১৯৪৯ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিকুলেশনে উত্তীর্ণ হন জগৎশি গোপালগন্জ ইংরেজী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। এর পর তিনি ভর্তি হন সিলেটের মুরারীচাঁদ (এম সি) কলেজে। ১৯৫১ সালে মুরারীচাঁদ কলেজ থেকে আই এ পাশ করেন। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিকম ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি লন্ডনে পড়াশুনা করেন  (আই সি এ ই ডাব্লিউ) থেকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট (সি এ) ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি যুক্তরাজ্যে অ্যাডভান্সড ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন। তিনি আর ও শিক্ষা গ্রহন করেন আর্থিক ও মুদ্রানীতি এবং উন্নয়ন অর্থনীতি বিশেষায়িত নিয়ে। ১৯৬২ সালে পেশাজীবী হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন।

পারিবারিক জীবন

সাইফুর রহমান ১৯৬০ সালের ১২ জুলাই বিবাহ বন্দনে আবব্দ হন বেগম দুররে সামাদ রহমানের সাথে। তিনি চট্রগ্রাম নগরীর  এক অভিজাত খান্দানি পরিবারের কৃতি কন্যা। এই দম্পতির সুখময় দাম্পত্য জীবনের ফসল -মহান আল্লাহর দান, চার সন্তান। সাইফুর রহমান দুুুুুুুররে সামাদ দম্পতির তিন পুত্র সন্তান এবং এক কন্যা সন্তানের জনক-জননী ছিলেন। সন্তানগণ উচ্চ শিক্ষিত এবং কর্ম জীবনে সু-প্রতিষ্ঠিত। তাদের বড় পুত্র এম.নাসের রহমান পিতার সাথে রাজনীতিতে যোগ দেন। তিনি মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে সাংসদ এবং জেলা বি.এন.পি-র সভাপতি হন। এখন ও তিনি সেই দায়িত্ব পালন করছেন। 

কর্ম জীবন

সাইফূর রহমান একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট ছিলেন। চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট ব্যবসার বিভিন্ন  ক্ষেত্র যেমন হিসাব সংরক্ষণ, নিরীক্ষণ, অর্থায়ন, ব্যাবস্থাপনা এবং করসংক্রান্ত কাজ করে থাকেন। সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদবা সচরাচর কোন হিসাবরক্ষণ প্রতিষ্ঠানে, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কিংবা কোন নিয়োগকর্তার পক্ষে সেবা প্রদান করেন। রাজকীয় সনদপ্রাপ্ত সংগঠনের সদস্য হতে গেলে একজন প্রার্থীকে সংগঠনের নিয়ম অনুযায়ী কয়েকটি ধাপে সজ্জিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। একই সাথে ৩ থেকে ৪ বছরের পেশাগত প্রশিক্ষণ গ্রহন করতে হয়। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় বেতন কমিশনে প্রাইভেট সেক্টর হতে একমাত্র সদস্য মনোনীত হন। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় বেতন কমিশনের সদস্য ও ছিলেন ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে। 

সাইফুর রহমান ১৯৯৪ সালে স্পেনের মাদ্রিদে বিশ্ব ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সুবর্ণ জয়ন্তী সম্মেলনের গভর্নর নির্বাচিত হন। ব্রিটিশ অক্সিজেনের উচ্চ বেতনের উর্ধ্বতন কর্র্মকর্র্তা হিসাবে পাকিস্তানের রাজধানী করাচীতে অবস্থান ও উচ্চ মহলের সঙ্গে চলাফেরা উঠা বসা করেন। এম.সাইফুর রহমান পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর বাঙালিদের প্রতি বিমাতা সুলভ আচরণে মন কষ্ট পান। ১৯৮০ থেকে ১৯১৯৮২ ও ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ মেয়াদে তিনি বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, আইডিবি, আইএফডিতে বাংলাদেশের গভর্নর ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংক এর সাবেক গভর্নর, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমদ সাইফুর রহমান একজন কিংবদন্তী পুরুষ শিরোনামের নিবন্ধে যথার্থই বলেন। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা সুশাসন এবং দক্ষতা সেসময় অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল। জনাব সাইফুর রহমানের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সদিচ্ছার জন্যই।

রাজনৈতিক জীবন

 সাইফুর রহমান ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় যুগ দেন ছাত্র রাজনীতিতে এবং নতুন জীবনের সন্ধান পান। তিনি সলিমুল্লাহ হল ছাত্র ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন-বাঙালি জাতীয়তা বাদী আন্দোলনের চেতনার উন্মেষ ঘটায়। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জাতীয় কৃষ্টি সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য-শায়ত্ত শাসন ও স্বাধিকার এর প্রশ্নটিও নিহিত ছিল। এ আন্দোলনের এক নেতা হিসাবে আবিভূত হয়েছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আপোষহীন নেতা, স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকার জন্য তিনি গ্রেফতার হয়ে এক মাস কারাবরণ করেন। তিনি জাতীয় রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভার বাণিজ্য উপদেষ্টা হিসেবে।

তিনি ১৯৭৭ সালে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলে যোগ দেন। তখন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে রুপান্তরিত হয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন সিলেট-১৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। 

তিনি টেকনোক্র্যাট অর্থমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী হিসেবে সিলেট ৪-আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দলের প্রাথী হিসেবে মৌলভীবাজার-৩ ও সিলেট-৪ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী হিসেবে তিনি সিলেট-১ ও মৌলভীবাজার-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন সবচেয়ে বেশি এবং সর্বোচ্চ ১২ বার জাতীয় বাজেট পেশ করেন।

মৃত্যু

২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজার থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে এই মহান ব্যক্তি মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে প্রাণ ত্যাগ করেন। ঢাকা, সিলেট, মৌলভীবাজারে বিশাল বিশাল নামাজে জানাজা শেষে তাঁকে তার গ্রামের বাড়ি বাহার মর্দ্দন পারিবারিক কবরস্থানে তার প্রিয় জীবন সঙ্গীনী বেগম দুররে সামাদ রহমানের কবরের পাশে দাফন করা হয়। এত বছর পর তাঁর কবরের মাটি পুরাতন হয়ে গেলেও তিনি স্মৃতির গভীরে হারিয়ে যান নি-আছেন আমাদের অন্তরে, অনুভবে।

তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা। তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের এই ব্লগটি পড়ুন

Related Posts

Leave a Comment