বাউল সম্রাট লালন শাহ

বাউল সম্রাট লালন শাহ এর সম্পুর্ণ জীবনী

by jamil

ভারত উপ-মহাদেশের প্রখ্যাত বাউল সম্রাট লালন শাহ একাধারে বাউল সাধক, গীতিকার, সুরকার ও গায়ক-এককথায় চারণ শিল্পী। যিনি লালন সাঁই, ফকির লালন, লালন শাহ, মহাত্মা লালন নামেও পরিচিত। লালনকে বাউল গানের অগ্রদূতদের অন্যতম একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং ‘বাউল-সম্রাট’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।

জন্ম

প্রখ্যাত বাউল সম্রাট লালন শাহ এর জন্ম কোথায় তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। লালন শাহ নিজে কখনো তা প্রকাশ করেননি। কিছু সূত্রে পাওয়া যায় লালন ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশের) ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু উপজেলার হারিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, বাংলা ১৩৪৮ সালের আষাঢ় মাসে প্রকাশিত মাসিক মোহম্মদী পত্রিকায় এক প্রবন্ধে লালনের জন্ম যশোর জেলার ফুলবাড়ী গ্রামে বলে উল্লেখ করা হয়। কোন কোন লালন গবেষক মনে করেন, লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার চাপড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত ভাড়ারা গ্রামে জন্মেছিলেন।

ধর্ম

প্রখ্যাত বাউল সম্রাট লালন শাহ এর জীবদ্দশায় তাঁকে কোন ধরনের ধর্মীয় রীতি-নীতি পালন করতে দেখা যায়নি। তিনি হিন্দু ও ইসলাম ধর্মে প্রথাগত অনুশাসন সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত ছিলেন। কিন্তু কোনো ধর্মই নিষ্ঠার সাথে পালন করেন নি। সব ধর্মের বন্ধন ছিন্ন করে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন লালন।

লালন বলেন,

সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে

লালন বলে, 

জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।

জীবনী

একসূত্র থেকে জানা যায়, লালন শাহের পিতার নাম কাজী দরীবুল্লাহ্ দেওয়ান ও মাতার নাম আমিনা খাতুন। কাজী তাদের বংশগত উপাধি। হিতকরী পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ নিবন্ধে বলা হয়েছে, লালন তরুণ বয়সে একবার তীর্থভ্রমণে বের হয়ে পথিমধ্যে গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। তখন তার সাথীরা তাঁকে ভেলায় ভাসিয়ে দিয়ে চলে যায়। কালিগঙ্গা নদীতে ভেসে আসা মুমূর্ষু লালনকে উদ্ধার করেন মলম শাহ। মলম শাহ ও তার স্ত্রী মতিজান তাকে বাড়িতে নিয়ে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। এরপর লালন তার কাছে দীক্ষিত হন এবং কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে স্ত্রী ও শিষ্যসহ বসবাস শুরু করেন। কথিত আছে গুটিবসন্ত রোগে তিনি একটি চোখ হারিয়েছিলেন। ছেউড়িয়াতে তিনি দার্শনিক গায়ক সিরাজ সাঁইয়ের সাক্ষাতে আসেন এবং তার দ্বারা প্রভাবিত হন। পরে তাঁর কাছে দীক্ষা নেন।

লালনের আখড়া

লালন শাহ কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার ছেউড়িয়াতে একটি আখড়া তৈরি করেন। কুষ্টিয়া শহর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে ছেঁউড়িয়ায় তার আখড়া অবস্থিত। যেখানে তিনি তার শিষ্যদের নীতি ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিতেন। তার শিষ্যরা তাকে “সাঁই” বলে সম্বোধন করতেন। অনেক দূর পর্যন্ত বাংলার ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বহুসংখ্যক লোক লালন ফকিরের শিষ্য ছিলেন। শোনা যায় তাঁর শিষ্যের সংখ্যা প্রায় দশ হাজারের বেশি ছিল। আখড়ার প্রবেশ মুখের দু’পাশে রয়েছে বিভিন্ন দোকান। রয়েছে কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা, বাঁশি, একতারা, নানা রকম বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি  কাঠের তৈরি নানা জিনিসপত্র। কয়েকটি দোকানে বিক্রি করা হচ্ছে  লালনের ভাস্কর্য, ছোটদের খেলনা। সাড়ে ১৪ একর জায়গার ওপর নির্মিত আখড়ায় রয়েছে লালন একাডেমি ভবন ও কমপ্লেক্স, পাঠাগার, অডিটোরিয়াম, রিসোর্স সেন্টার ও লালন জাদুঘর। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে আছেন সাধক বাউল লালন শাহ। তার সমাধির পাশে রয়েছে পালক মা মতিজান ফকিরানী এবং বাহিরে পালক পিতা মাওলানা মলম শাহর সমাধি।

বিশ্ব সাহিত্যে লালনের অবদান

লালনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। তিনি প্রায় দুহাজার গান রচনা করেন। তাঁর গান মরমি ব্যঞ্জনা ও শিল্পগুণে সমৃদ্ধ। সহজ-সরল শব্দময় অথচ গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ও মর্মস্পর্শী তাঁর গানে মানব জীবনের আদর্শ, মানবতাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। লালন শাহের গান ও দর্শনের দ্বারা অনেক বিশ্বখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক প্রভাবিত হয়েছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ লালনের মৃত্যুর ২ বছর পর তার আখড়া বাড়িতে যান এবং লালনের দর্শনে প্রভাবিত হয়ে ১৫০টি গান রচনা করেন। লালন শাহের মানবতাবাদী দর্শনে প্রভাবিত হয়েছেন সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আমেরিকান কবি এলেন গিন্সবার্গ লালনের দর্শনে প্রভাবিত হন এবং তার রচনাবলিতেও লালনের রচনাশৈলীর অনুকরণ দেখা যায়। তিনি আফটার লালন নামে একটি কবিতাও রচনা করেন। লালনের গান লালনগীতি বা লালন সংগীত হিসেবে পরিচিত। সমগ্র বিশ্বে, বিশেষ করে বাংলাদেশসহ সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে লালনের গান বেশ জনপ্রিয়। শ্রোতার পছন্দ অনুসারে বিবিসি বাংলার করা সর্বকালের সেরা ২০টি বাংলা গানের তালিকায় লালনের “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়” গানটির অবস্থান ১৪তম।

বাউল দর্শন

লালনকে বাউল মত এবং গানের একজন অগ্রদূত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর গানের জন্য উনিশ শতকে বাউল গান জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বাউল গান মানুষের জীবন দর্শন সম্পৃক্ত বিশেষ সুর সমৃদ্ধ। বাউলরা সাদামাটা জীবনযাপন করেন এবং একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোই তাদের অভ্যাস। ২০০৫ সালে ইউনেস্কো বাউল গানকে বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমূহের মাঝে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে।

লালনের কয়েকটি জনপ্রিয় গান

  • সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
  • সময় গেলে সাধন হবে না
  • আছে আদি মক্কা এই মানব দেহে
  • তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে
  • এসব দেখি কানার হাট বাজার
  • মিলন হবে কত দিনে
  • খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়
  • কে বানাইলো এমন রঙমহল খানা
  • জাত গেলো জাত গেলো বলে
  • খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়
  • আপন ঘরের খবর লে না
  • যেখানে সাঁইর বারামখানা

মৃত্যু

১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর লালন ১১৬ বছর বয়সে কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেউড়িয়াতে নিজ আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর দিন ভোর ৫টা পর্যন্ত তিনি গান-বাজনা করেন এবং এক সময় তাঁর শিষ্যদের বলেন, “আমি চলিলাম” এবং এর কিছু সময় পরই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর নির্দেশ বা ইচ্ছা না থাকায় তাঁর মৃত্যুর পর হিন্দু বা মুসলমান কোন ধরনের ধর্মীয় রীতি নীতি পালন করা হয় নি। তারই উপদেশ অনুসারে ছেউড়িয়ায় তার আখড়ার একটি ঘরের ভিতর তার কবর দেওয়া হয়। 

‘পার করো হে দয়াল চাঁদ আমারে/

ক্ষমা হে অপরাধ আমার/

এই ভব কারাগারে…’

মৃত্যুর আগে এটাই ছিল সাধক বাউলের শেষ গান। চলচ্চিত্র অভিনয়ে এক অসামান্য ভূমিকা পালন করেন সবার প্রিয় অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি। হুমায়ুন ফরীদি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের এই ব্লগটি পড়ুন

Related Posts

Leave a Comment