জাহানারা ইমাম

জাহানারা ইমাম এর জীবনী

by jamil

জন্ম ও শৈশব

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এর জন্ম ১৯২৯ সালের ৩ মে। পিতা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ আবদুল আলী এবং মাতা সৈয়দা হামিদা বেগমের স্নেহে বেড়ে উঠেছেন জাহানারা ইমাম। পিতার চাকরি বদলির সুবাদে দেশের নানাপ্রান্তে তার শৈশবকাল অতিবাহিত হয়েছে। সুন্দরপুরসহ বিভিন্ন জেলা শহরে ঘুরে ঘুরে এক কিশোরীর বড় হয়ে উঠার কাহিনী তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন তার স্মৃতিকথা অন্যজীবন-এ।

শিক্ষা

জাহানারা ইমাম এর শৈশবকালে মুসলিম পরিবারের মেয়েদের নিকট আধুনিক শিক্ষালাভের দ্বার উন্মুক্ত ছিল না। তবে তিনি তাঁর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পিতা আবদুল আলীর তত্ত্বাবধানে রক্ষণশীলতার বাইরে এসে আধুনিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন। ১৯৪২ সালে জাহানারা ইমাম ম্যাট্রিক পাস  করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন রংপুর কারমাইকেল কলেজে। জাহানারা ইমাম যখন রংপুর কারমাইকেল কলেজে  ভর্তি হন তখন তিনিসহ মোট তিনজন মুসলিম নারী ওই কলেজে শিক্ষার্থী হিসেবে ছিলেন। ১৯৪৫ সালে তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ১৯৪৫ সালে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে বিএ তে ভর্তি  হন। ১৯৪৭ সালে বিএ পাস করেন জাহানারা ইমাম। ১৯৬০ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে  বিএড ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এমএ সম্পন্ন করেন।  পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথমস্থান অধিকার করেন। জাহানারা ইমাম ১৯৬৪ সালে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে  যুক্তরাষ্ট্র যান। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এমএ (পার্ট-টু) পাস করেন।

বৈবাহিক জীবন

রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্রী থাকাকালীন জাহানারা ইমামের পরিচয় হয় শরীফ ইমামের সাথে। পরিচয়  থেকে ঘনিষ্ঠতা। উভয় পরিবারে আলাপ আলোচনার পর তাদের সম্পর্ক পারিবারিক স্বীকৃতি পায়। জাহানারা ইমাম ১৯৪৮ সালের ৯ অগাস্ট পরিণয় সূত্রে বাঁধা পড়েন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার শরীফ ইমামের সাথে। বিয়েতে লাল বেনারসী এবং সোনার গয়নার পরিবর্তে সাদা সালওয়ার-কামিজ এবং রজনীগন্ধা ফুলের গহনা দিয়ে সেজেছিলেন তিনি। সাদা পোশাক ও অলংকারহীন এ বিয়ে যুগের তুলনায় তার অগ্রসর চিন্তার ইঙ্গিত বহন করে।

কর্মজীবন

জাহানারা ইমামের কর্মজীবন শুরু হয় স্কুলে শিক্ষকতার মাধ্যমে। কর্মময় জীবনের প্রথম কাল কাটে ময়মনসিংহ শহরে। সেখানে বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসাবে ১৯৪৮ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি কর্মরত ছিলেন। এরপর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত তিনি ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। ফুলব্রাইট স্কলার জাহানারা ইমাম আমেরিকা থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ১৯৬৬ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন| তিনি কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটেও খন্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে কাজ করেন। পরে তিনি নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন।

সাহিত্য ও লেখালেখি

জাহানারা ইমামের সাহিত্যচর্চা ছিল বহুমাত্রিক। একজন শিশু সাহিত্যিক হিসেবে লেখালেখির জগতে প্রবেশ জাহানারা ইমামের। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মূলত লেখক হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় ডায়েরি আকারে লেখা ‘একাত্তরের দিনগুলি’। জাহানারা ইমাম আত্মজ শহীদ রুমি ও মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা নিয়ে  স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’ প্রকাশের মাধ্যমে বাংলাভাষী সর্বস্তরের পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নেন। গ্রন্থে  বিধৃত নারকীয় ঘটনার বর্ণনায় মাতৃ-উৎকণ্ঠা প্রকাশের গভীরতায় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গঠন ও বিস্তারে তার এই  গ্রন্থ সর্বমহলে সমাদৃত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জীবনায় এই দলিল আজ ধ্রুপদী সাহিত্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত। এ গ্রন্থটির কারণে দেশে-বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেন তিনি।

সাহিত্য জীবন

তার সাহিত্য জীবন অনুবাদ, শিক্ষামূলক রচনা, স্মৃতিকথা, আত্মজীবনী, ভ্রমণকাহিনী, গল্প-উপন্যাস, টিভি সমালোচনা, শিশু কিশোরদের উপযোগী ছোটগল্প  সমৃদ্ধ। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে তিনি মুসলিম সমাজের নানা বিবর্তন, সংঘাত, সংঘর্ষ, আশা -আকাঙক্ষা, আত্ম-প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এবং সমাজে নারী জাগরণ ও প্রগতির বহু ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছেন। এছাড়াও দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধসহ নানা উত্থান-পতনের তিনি সাক্ষী ছিলেন। অর্জন করেছেন প্রচুর অভিজ্ঞতা। এ অভিজ্ঞতার প্রতিফলন দেখা যায় তার রচনাবলীতে। জাহানারা ইমামের সমগ্র রচনায় প্রগতিশীল চিন্তা,  মানবতাবাদ, মুক্তবুদ্ধি, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত জীবনবোধ, দেশপ্রেম এবং মুক্তিযুদ্ধ প্রাধান্য পেয়েছে।

রাজনৈতিক জীবন

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে জাহানারা ইমামের নাম ছড়িয়ে পরে তাঁর সামাজিক-রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য। অতীতে তিনি রাজনীতিসচেতন হলেও রাজনীতিবিদ ছিলেন না, এবার ভবিতব্যই তাঁকে রাজনীতির অঙ্গনে নিয়ে আসে। তাঁর প্রথম পুত্র রুমী একাত্তরে ছাত্রত্ব ত্যাগ করে দেশের মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন এবং পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে নিহত হন। বিজয় লাভের পর রুমীর বন্ধুরা জাহানারা ইমামকে সকল মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে বরণ করে নেন। তখন থেকেই তিনি ‘শহীদ জননী’র মর্যাদায় ভূষিত।

মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা

মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য জাহানারা ইমাম নিজেও সর্বদা সক্রিয় ছিলেন। তিনি বুদ্ধিজীবীদের পরিচালিত ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদবিরোধী নাগরিক কমিটি’, ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’ ইত্যাদি উদ্যোগের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। কিন্তু অচিরেই তিনি উপলব্ধি করেন যে, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষের মানুষদের একত্র করতে না পারলে বিরোধী দুষ্ট চক্রকে প্রতিরোধ করা যাবে না। ১৯৯২ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আহবায়ক হন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল বরেণ্য  বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিক দল ও কর্মিবৃন্দ, দেশপ্রেমিক তরুণ সমাজ এবং প্রজন্ম ৭১ তাঁর আহবানে এগিয়ে আসেন। তাঁদের সক্রিয় সমর্থনে জাহানারা ইমাম ১৯৭১-এর স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের বিরুদ্ধে গণ-আদালত গড়ে তোলেন।

গণ-আদালত ছিল স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের অপকর্মের বিরুদ্ধে একটি প্রতীকী প্রতিবাদ। কিন্তু তৎকালীন সরকার জাহানারা ইমামসহ গণ-আদালতের সঙ্গে যুক্ত ২৪জন বরেণ্য বুদ্ধিজীবীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করে এবং জাহানারা ইমাম মৃত্যুকালেও এ অভিযোগ থেকে মুক্তি পাননি।

মৃত্যু

বাংলাদেশের জনগণের কাছে তার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব অর্পণ করে ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় মিশিগানের ডেট্টয়েট নগরীর সাইনাই হাসপাতালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৬৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন জাহানারা ইমাম। ৪ জুলাই তার মৃতদেহ বাংলাদেশে আনা হয়। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সমন্বয় কমিটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার মৃতদেহ গ্রহণ করেন জাতীয় সংসদের তৎকালীন বিরোধীদলীয় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তাকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা গোরস্থানে সমাহিত করা হয়।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিদের মধ্যে অন্যতম নেতা হলেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের এই ব্লগটি পড়ুন

Related Posts

Leave a Comment