স্পিকার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী

স্পিকার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী এর জীবন

by Sayedur Rahman

স্পিকার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী বাংলাদেশের একজন  কূটনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ১৯৯৬ – ২০০১ পর্যন্ত স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত ছিলেন । স্পিকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ১৯৮৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৪১তম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন তিনি ।

কর্মস্থানে সংগ্রাম

কর্মস্থলের শুরুটা  ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগদান থেকে। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে পাকিস্তানি দূতাবাসে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জীবন রক্ষা করেন। একইসঙ্গে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।  বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফরাসি এবং ইতালীয় ভাষায় কথা বলতে পারতেন তিনি। স্বাধীনতার পর ভারতীয় লোকসভায়, প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী বক্তৃতা করার সৌভাগ্য অর্জন করেন।

স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সরকারি কর্মচারীদের দুই বছরের পদোন্নতি দেন। ফলে হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ১৯৫১ ব্যাচের ফরেন সার্ভিসের কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে তিনি বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। 

অকুতোভয় মানবতাবাদী হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন সপরিবারে নৃশংস হত্যা করা হয়, তখন তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছিলেন বেলজিয়ামে। দেশের মাটিতে না থাকায় তারা প্রাণে বেঁচে যান। তখন বেলজিয়ামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন সানাউল হক। তিনি শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানালে হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী তাদের জার্মানিতে আশ্রয় দেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ১৯৭৫ সালে জার্মানির রাষ্ট্রদূত ছিলেন। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নিরাপত্তার কথা ভেবে তাদের ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থাও করেন তিনি।

শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর ওপর উত্তেজিত হয় বঙ্গবন্ধুর খুনিরা। ঘাতকেরা হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রদূত থেকে প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং দেশে এনে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশের পরিস্থিতি কঠিন হওয়ায় জীবন রক্ষা পান। খুনিদের হাত থেকে  পরে তাঁকে ওএসডি করে দেশে নিয়ে আসা হয়।

স্পিকার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী

জাতীয় সংসদে স্পিকারের রুলিং

সপ্তম সংসদের (১৯৯৬-২০০১) অধিবেশন চলাকালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধীদলের সদস্যরা বঙ্গবন্ধু কে নিয়ে অহেতুক বিতর্ক করতেন। স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী শোক প্রকাশ করতেন, যে নেতার জন্ম না হলে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি হতো না। বাংলাদেশে স্বাধীন সার্বভৌম সংসদ প্রতিষ্ঠিত হতো না। সেই মহান নেতাকে নিয়ে কোনো ধরনের অহেতুক বিতর্ক হোক তা কামনার যোগ্য নয়। স্পিকার এ ধরনের বিতর্ককে অযৌক্তিক ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে বিবেচনা করতেন। বিধায় তিনি আইনগত ভাবে এ ধরনের পরিস্থিতি দমনের উদ‍্যোগ নেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সাংবিধানিকভাবে জাতির পিতা সে বিষয়ে একটি আইন প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এজন্যে তিনি বাংলাদেশ সংবিধান ভালো ভাবে গবেষণা করেন। তিনি সময়ের সাথে লক্ষ্য করেন। পঁচাত্তর পরবর্তী সরকারগুলো সকলের গোপনে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে জাতিরপিতা সম্পর্কিত বিধানগুলো বাদ দিয়ে সংবিধানের নতুন সংস্করণ মুদ্রণ করেছে।

এ ব‍্যাপারে তাকে তৎকালীন মাননীয় ডেপুটি স্পিকার (বতর্মান মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব মো. আব্দুল হামিদ) মাননীয় চীফ হুইপ , আইন মন্ত্রী জনাব আব্দুল মতিন খসরু, প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান অ্যাডভোকেট রহমত আলী এমপি।  এবং সংসদ সচিবালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলাপকালে পঁচাত্তর পরবর্তী সরকারসমূহের অপপ্রয়াসের বিষয় তুলে ধরতে। এবং তীব্র আন্দোলন প্রকাশ করতে দেখেছি। তিনি আমাদের নির্দেশ দেন অবিলম্বে পঁচাত্তর ট্র‍্যাজেড পূর্ব সংবিধানের সকল সংস্করণ সংগ্রহের যা তিনি তার কার্যালয়ে বিশেষভাবে সংরক্ষণ করেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণার পর স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সংসদের তৃতীয় অধিবেশনের বৈঠকে তার ঐতিহাসিক রুলিং প্রদান করেন।

স্পিকার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী

তার দেয়া উদৃতি

তার দেয়া উদৃতি  হলো……….

(উদৃতি শুরু)“আমাদের সংসদে আমাদের সংবিধানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতার সৃকৃতি দেওয়া হয়েছে যে ধারা অনুযায়ী। সেই সৃকৃতি দেওয়া হয়েছে সেটা কোন দিন বাতিল করা হয় নাই। অতএব, আমাদের জাতির পিতাকে কোনভাবে, প্রত‍্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অপমান করলে সেটা সংবিধানের প্রতি অসম্মান দেখানো হয়। তাই আমি অনুরোধ করব আপনারা সবাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মরহুমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন কথা-বার্তায়। তিনি আমাদের জাতির পিতা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। যে জাতি তার জাতির পিতাকে শ্রদ্ধা দেখাতে পারে না সেই জাতির উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব নয়। আমার মতে বাঙ্গালী জাতি যতদিন এই পৃথিবীতে থাকবেন ততদিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির পিতা থাকবেন।” (উদৃতি শেষ)

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গুণমুগ্ধ এবং তার একনিষ্ঠ অনুসারী হিসাবে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর শেষসময়ে জাতির পিতা সম্পর্কে একটি যথাযথ রুলিং প্রদান করেন। নিজের একটি নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব বলে বিবেচনা করেন। তার প্রদত্ত রুলিং এর মধ্যেই বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে:

(উদৃতি শুরু) “স্পীকার হিসেবে আমার নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে সংবিধানকে সংরক্ষণ করা, সংবিধানকে রক্ষা করার শপথ আমি নিয়েছি। আমি সংবিধানকে রক্ষণ করেছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবিধানিকভাবে জাতির পিতা হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।” (উদৃতি শেষ)

সম্মাননা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের কলেজ অব উইলিয়াম অ্যান্ড ম্যারি থেকে ১৯৮৪ সালে ‘মহাত্মা গান্ধী শান্তি পুরস্কার লাভ করেন   হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। বিশ্ব শান্তিরক্ষার্থে নিখুঁত কূটনৈতিক অবদানের জন্য তাকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। 

এছাড়াও স্পিকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ‘ইউ থান্ট শান্তি পদক’ অর্জন করেছিলেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তাকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়। এছাড়াও তার সম্মানে ঢাকা থেকে সিলেট শহরের প্রবেশপথে একটি চত্বরের নামকরণ করা হয়েছে ‘হুমায়ূন রশীদ চত্বর’। ১৯৯৬ সালের ১৪ জুলাই তিনি সর্বসম্মতিক্রমে জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু তিনি এ পদে বহাল ছিলেন।

সমাধি স্থান

স্পিকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ১০ জুলাই ২০০১ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। সিলেটের শাহজালালের মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে সমাহিত করা হয়

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সময়কালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান সম্পর্কে জানতে আমাদের এই ব্লগটি পড়ুন

Related Posts

Leave a Comment