ঈসা খাঁ

ঈসা খাঁ এর জীবনী এবং সমকালীন ইতিহাস

by Sayedur Rahman

ঈসা খাঁ বাংলার বারো ভুঁইয়া বা প্রতাপশালী বারোজন জমিদারদের অন্যতম।ঈসা-খাঁ এবং বারো জন জমিদার একসাথে বাংলায় স্বাধীনভাবে জমিদারী স্থাপন করে। তাঁর পিতা নাম সোলায়মান খাঁ ছিলেন আফগানিস্তানের সোলায়মান পার্বত্য অঞ্চলের এক আফগান দলপতির বংশধর।মুঘল সম্রাটের সেনাপতি মানসিংহ জীবনে দুব্যক্তিকে পরাজিত করতে পারেননি বলে কথিত আছে- চিতরের রানা প্রতাপ সিং ও সোনারগাঁওয়ের ঈসা খাঁ।

জন্ম

১৫২৯ বা ১৫৩৭ সালে ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার সরাইল পরগণায় ঈসা খাঁর জন্ম। তাঁর পিতা কালিদাস গজদানী ভাগ্যান্বেষণে অযোধ্যা থেকে গৌড়ে এসে স্বীয় প্রতিভা গুণে রাজস্বমন্ত্রী পদে উন্নীত হন।

তাঁর পিতা কালিদাস গজদানী উচ্চশিক্ষার জন্য মহাভারত  থেকে ভারত  বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলে আসেন এসে নিজের প্রতিভা গুণে রাজস্বমন্ত্রী পদে উন্নীত হন। পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তাঁর নাম হয় সুলাইমান খাঁ। তিনি সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের মেয়েকে বিয়ে করে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার সরাইল পরগণা ও পূর্ব মোমেনশাহী অঞ্চলের জমিদার ব্যবস্থা লাভ করেন।

১৫৪৫ সালে শের শাহের পুত্র ইসলাম শাহ দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করার পর সুলাইমান খাঁ দিল্লীর আনুগত্য অস্বীকার করলে কৌশলে তাঁকে হত্যা করে তাঁর দুই নাবালক পুত্র ঈসা খাঁ এবং ইসমাইল খাঁকে একদল তুরানী ব্যবসায়ী নিকট বিক্রি করা হয়। ১৫৬৩ সালে ঈসা খাঁর চাচা কুতুব খাঁ রাজকার্যে নিযুক্তি লাভ করে বহু তদন্তের পর সুদূর তুরান দেশের এক ধনী ব্যক্তির কাছ থেকে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে ২ ভাইপো উদ্ধার করেন। এ সময় ঈসা খাঁর বয়স মাত্র ২৭ বছর।

ঈশা খাঁ – মানসিংহের যুদ্ধ

সুলতান তাজ খাঁ বাংলা সালতানাতের শেষ রাজবংশ (১৫৬৪-৬৫) সিংহাসনে আরোহণ করে ঈসা খাঁকে তাঁর পিতার জমিদার ব্যবস্থা ফেরত দেন। বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান দাউদ খাঁ কররানীর রাজত্বকালে (১৫৭২-৭৬) ঈসা খাঁ বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন অসাধারণ বীরত্বের জন্যে।

১৫৭৫ সালের অক্টোবর মাসে বাংলার সুবাদার মুনিম খাঁর মৃত্যু হলে আফগান নেতা দাউদ খাঁ কররানী স্বাধীনতা ঘোষণা করে নিজ নামে বাংলা এবং বিহারে খুতবা পাঠ করান । স্বাধীন ভূইয়ারাও তাকে অনুসরণ করে মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন ।

ঈসাঁ খা মানসিংহের যুদ্ধ১৫৯৬ সালে বার ভূঁইয়াদের অন্যতম ঈশা খাঁর সঙ্গে মোগল সেনাপতি রাজা মানসিংহের দ্বন্দ্ব যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধ হয় ব্রহ্মপুত্র ও শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গমস্থলে বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার সর্ব দক্ষিণ প্রান্তের টাঙ্গার গ্রামে। সে সময় শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব তীরে ছিল রাজা মানসিংহের রাজধানী টোক নগরী। এটির অবস্থান গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার উত্তর-পূর্বাংশে। রাজা মানসিংহ ১৫৯৫ সালে রাজস্থান থেকে তার রাজধানী টোক নগরীতে সরিয়ে আনেন। ব্রহ্মপুত্র ও শীতলক্ষ্যার সঙ্গমস্থলে ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ তীরে ছিল টাঙ্গাব গ্রাম ও টোক নগর। ব্রহ্মপুত্র নদের অপর পাড়ে ছিল ঈসা খাঁর বিখ্যাত দুর্গ এগারসিন্দু। ইতিহাস মতে, ঈসা খাঁর অনুপস্থিতিতে মানসিংহ এগারসিন্দু আক্রমণ করেন। সংবাদ পেয়ে দুর্গ রক্ষায় ছুটে আসেন।

কিন্তু তার সৈন্যরা এতোই ক্লান্ত ছিল যে, তারা যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে ঈশা খাঁ মানসিংহকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহ্বান করেন। মানসিংহ এ প্রস্তাবে রাজি হন। যুদ্ধে এক পর্যায়ে মানসিংহের তরবারি ভেঙে গেলে ঈশা খাঁ তাকে আঘাত না করে নিজের তরবারি মানসিংহকে দেন কিন্তু মানসিংহ তরবারি না নিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে আসেন। ঈশা খাঁ তখন মানসিংহকে মল্লযুদ্ধে আহ্বান করেন। কিন্তু মানসিংহ তা গ্রহণ না করে ঈশা খাঁকে আলিঙ্গন করেন। তার সাহস ও মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। মানসিংহ ঈশা খাঁকে নিয়ে সম্রাট আকবরের দরবারে গেলে তিনি ঈশা খাঁকে ২২ পরগনার শাসক নিয়োগ করেন ও তাকে মসনদ-ই আলা উপাধিতে ভূষিত করে স্বদেশে ফেরত পাঠান।

সোনারগাঁও বাংলাদেশের প্রাচীন রাজধানী

মূলত এটি ছিল ঈশা খাঁর আমলে রাজধানী ।

ঈশা খাঁর স্ত্রী সোনাবিবির নামে সোনারগাঁও এর নাম রাখা হয়। 

এখানে সোনাবিবির মাজার আছে ও পাঁচবিবির মাজার আছে এবং গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের সমাধি রয়েছে । এছাড়াও সোনারগাঁওয়ে ইব্রাহীম দানিশমান্দ এর দরগা এবং আরো নানারকম  ইত্যাদি স্থাপনা রয়েছে ।

১৬১০ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে ঢাকা সুবে বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষিত হবার পূর্ব পর্য়ন্ত সোনারগাঁও ছিল পূর্ববঙ্গের রাজধানী। ঈশা খাঁ ও তাঁর বংশধরদের শাসনামলে সোনারগাঁও ছিল পূর্ববঙ্গের রাজধানী। সোনারগাঁও-এর আরেকটি নাম ছিল পানাম।পানাম নগরের নির্মিত ভবনগুলো ছোট লাল ইট দ্বারা তৈরী। ভবনগুলো কোথাও একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন, আবার কোথাও নিকটবর্তী।অধিকাংশ ভবনই আয়তাকার এবং উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত।দীর্ঘ একটি সড়কের উভয় পাশে দৃষ্টিনন্দন ভবন স্থাপত্যের মাধ্যমে পানামনগর গড়ে উঠেছিল। উভয় পাশে মোট ৫২টি পুরোনো বাড়ী এই ক্ষুদ্র নগরীর মূল আকর্ষণ।

পানাম শহরের ঠাকুরবাড়ি ভবন ও ঈশা খাঁ’র তোরণকে একত্রে নিয়ে মোট প্রায় ষোল হেক্টর স্থান জুড়ে লোকশিল্প ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের অবস্থান। এখানে ১টি জাদুঘর, ১টি লোকজ মঞ্চ, সেমিনার কক্ষ ও কারুশিল্প গ্রাম রয়েছে। শিল্পাচার্য জয়নুল লোক এবং কারুশিল্প জাদুঘর অবস্থিত । এখানকার জাদুঘরে প্রায় সাড়ে চারহাজার নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। প্রতি শুক্রবার থেকে বুধবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্য়ন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। তবে শুক্রবার দুপুর ১২টা থেকে দুপুর ২টা পর্য়ন্ত জুমার নামাজের জন্য জাদুঘর বন্ধ থাকে।

এক সময় পানাম নগর এই এলাকাটি উন্নিশ শতকে সোনারগাঁওয়ের উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ীদের সব থেকে ভালো একটি বাসস্থান ছিলো । এখানে সব থেকে বেশি কাপড় ব্যবসায়ীরা বাস করতেন । এখানকার সুদৃশ্য বাড়িগুলো এখন ধ্বংসের মুখে পরে আছে ।

জীবন এর শেষমুহূর্ত

ঈসা খাঁ রাজ্য শাসনের প্রয়োজনে বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করতেন। এমনই এক ভ্রমণের সময় ১৫৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে মহেশ্বরী পরগণার অন্তর্গত বক্তারপুর গ্রামে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার বক্তারপুর গ্রামে এই সমাধিকে ঈশা খাঁর বলে চিহ্নিত করেছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি দল সম্প্রতি এটি পরিদর্শন করে। ঈসা খাঁর মৃত্যুর পরে তার পুত্র মুসা খাঁ সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ভূঁইয়াদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ছিলেন। বৃহত্তর ঢাকা জেলা, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ জেলার অধিকাংশ নিয়ে তার রাজত্ব বিস্তৃত ছিল।১৬৬১ সালের এপ্রিল মাসে মুঘলদের সাথে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে সোনারগাঁয়ের পতন ঘটে। মুসা খাঁ মুঘলদের আনুগত্য স্বীকার করেন। আর এর ফলেই বাংলায় বারোভুঁইয়াদের পতন অনেকটা নিশ্চিত হয়ে পরে। এভাবেই ইতি ঘটে বারোভুঁইয়াদের প্রায় তিন যুগের শাসনামলের।

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী যাকে মালিক গাজী ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি নামেও পরিচিতি পাওয়া যায়। বখতিয়ার খলজী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের এই ব্লগটি পড়ুন

Related Posts

Leave a Comment